ব্যাক্তিগত বিশ্বাস,সংবাদ মাধ্যম ও নৈতিকতার মানদণ্ড


প্রকাশের সময় :২ মে, ২০১৮ ১০:২৮ : অপরাহ্ণ 589 Views

 

বান্দরবান অফিসঃ-এক বন্ধুর মারফত লিংক পাওয়ামাত্রই, স্বাভাবিকভাবেই অত্যন্ত আগ্রহ সহকারে, পড়তে শুরু করে করি। কারণ পার্বত্য চট্রগ্রামের যে ঘটনাকে কেন্দ্র করে এক দৈনিকের সম্পাদকীয় প্রকাশ করা হয়েছে, ঐ সাম্প্রতিক অপহরণ ছাড়াও পূর্বের আরো কিছু অপহরণের ঘটনা নিয়ে ইতোমধ্যেই এখানেই লিখেছিলাম।
আগ্রহীগণ চাইলে পার্বত্য চট্রগ্রামের বিভিন্ন অপহরণের ঘটনা নিয়ে লেখা এই লিংকটি ঘুরে আসতে পারেন, http://www.somewhereinblog.net/blog/MaherIslam/30235131

ইংরেজী দৈনিক নিউ এজ-এ ‘Government must investigate CHT leader abduction case’ শিরোনামে গত ০১ মে ২০১৮ তারিখে প্রকাশিত এক সম্পাদকীয়তে মন্তব্য করা হয়েছে যে, ‘সরকারকে অবশ্যই পার্বত্য নেত্রীদের অপহরণ বিষয়টি তদন্ত করতে হবে।’ অপহৃতা দুই নারী নেত্রীর বয়ানে বলা হয়েছে, “তাদেরকে বিভিন্ন ক্যাম্প ও চেক পয়েন্ট অতিক্রম করে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, অথচ কোথাও তাদেরকে নিরাপত্তা তল্লাশীর মুখোমুখি হতে হয়নি। তাদের এই বর্ণনা জনমনে এই বিশ্বাস জোগাবে যে, অপহরণের ঘটনার সাথে নিরাপত্তা বাহিনীর যোগাযোগ থাকতে পারে।” সম্পাদকীয়তে আরো জানানো হয়েছে যে, ইন্টার-সার্ভিসেস পাবলিক রিলেসন্স কর্তৃক ‘অপহরণের সাথে আর্মির জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার’ করা হয়েছে।পুরোটা পড়তে গিয়ে, বিশেষ করে ভাষার এমন এক সুর কানে বাজলো, কেন যেন মনে হয়েছে যে, অপহৃতা ঐ দুই নারী নেত্রীর কেউ একজন যদি এই সম্পাদকীয় লিখতে সহায়তা না করে থাকেন তাহলে অন্তত তাদের পক্ষ থেকে কেউ না কেউ সহায়তা করলেও করে থাকতে পারেন।যাই হোক, এতে দোষের কিছু দেখি না। কেননা নির্যাতিত যে কোন ব্যক্তির জন্যে সহানুভূতি প্রকাশ করা বা নির্যাতনের শিকার কারো জন্যে সুবিচার চাইতে সহায়তা করা সকলেরই মানবিক দায়িত্ব। সুতরাং এই সম্পাদকীয়তে নির্যাতিতার সমর্থনে সেই মানবিকতাই ফুটে উঠেছে, প্রকাশ পেয়েছে বিচারের দাবিতে দৃঢ় কণ্ঠের আওয়াজ; যা অবশ্যই প্রশংসনীয়।তবুও প্রশ্ন থেকে যায়। বিশেষ করে, যখন দেখা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত সকল নির্যাতন বা অন্যায়ের পরিবর্তে বেছে বেছে শুধুমাত্র বিশেষ ব্যক্তি বা দলকেন্দ্রিক ঘটনার ব্যাপারেই সহানুভূতি প্রকাশ বা বিচারের দাবিতে কোনো কোনো মহল উচ্চকন্ঠ থাকেন,তখন প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক? সকল ভিক্টিম বা অন্যায়ের দিকে তাকানোর পরিবর্তে যদি বা কিছু ভিক্টিমের বা কিছু সম্ভাব্য অন্যায়কারীর পরিচয়ের দিকেই পুরো মনোযোগ ব্যয় করা হয়, তাহলে কি ধারণা তৈরি হয়?কেন জানি না, সম্পাদকীয়তে এমন একটা সুর ছিল যে, যাতে পাঠকের মধে্যে এক ধরনের কৌতুহল জন্ম নিতে পারে। সেই কৌতুহল থেকেই দৈনিক নিউ এজ-এর ওয়েব পেজে গিয়ে ‘খাগড়াছড়ি’ লিখে অনুসন্ধান করা হলো। উদ্দেশ্য ছিল, এখানে ‘খাগড়াছড়ি’ সংক্রান্ত সাম্প্রতিক কি কি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে তা দেখা। রেজাল্ট পেতে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো- ঐ দুই নেত্রীর অপহরণের প্রতিবাদে তিন পার্বত্য সংগঠনের ডাকা অবরোধের সংবাদই ‘খাগড়াছড়ি’ সংক্রান্ত সর্বশেষ সংবাদ যা কিনা গত ২২ মার্চ ২০১৮ তে প্রকাশিত হয়েছিল।কৌতুহল আরেকটু বাড়ল, কারণ ইতোমধ্যেই সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল যে, খাগড়াছড়ির মহালছড়ি উপজেলার মাইসছড়ি এলাকায় কাঠ কিনতে গিয়ে গত ১৬ এপ্রিল ২০১৮ তারিখে নিখোঁজ হয়েছে তিন বাঙ্গালী। পরবর্তীতে, এ নিয়ে খাগড়াছড়িতে হরতালও হয়েছে, এমনকি অপহৃতদের স্বজনরা অভিযোগ করেছেন যে, “সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন অজুহাতে বিকাশের মাধ্যমে দুই লাখ ২৫ হাজার টাকা নিয়ে গেলেও অপহৃতদের মুক্তি দেয়নি।”কিন্তু, দৈনিক নিউ এজ-এর ওয়েব পেজে গিয়ে অনুসন্ধান করেও এ সংক্রান্ত কোন নিউজ না পাওয়ায় কৌতুহলের পারদের মাত্রা আরেকটু উঁচুতে উঠল। ফলে একই নিউজ পেপারে ১৬ এপ্রিলের পরে এই অপহরণ, অপহরণ পরবর্তী বিভিন্ন সাম্পদায়িক উত্তেজনা বা হরতালের সংবাদ নিয়ে কিছু আছে কিনা খুঁজে বের করার চেস্টা করা হলো। কিন্তু, এবারও কিছু পাওয়া গেলো না।বরং অনুসন্ধান করতে গিয়ে যা পাওয়া গেলো তা হল, পাহাড়ি দুই নারী নেত্রী অপহরণের প্রতিবাদে পাহাড়ি সংগঠনগুলোর ডাকা ২১ মার্চ ২০১৮ তারিখের অবরোধ নিয়ে চারটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু, প্রায় অনুরূপ হওয়া সত্ত্বেও তিন বাঙ্গালী অপহরণের প্রতিবাদে বাঙ্গালী সংগঠনের ডাকা ২৩ এপ্রিল ২০১৮ তারিখের হরতাল নিয়ে একই সংবাদপত্রে কোনো খবর খুঁজে পাওয়া গেলো না।সচেতন পাঠকের মনে উঠতে পারে, একজন সংবাদদাতা কীভাবে তিনজন বাঙ্গালীর অপহরণ এবং এর পরবর্তীতে অপহরণের প্রতিবাদের ডাকা হরতালের পুরো ঘটনাগূলো মিস করলেন? সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠবে, যে সংবাদপত্র ২১ মার্চের এক অবরোধ নিয়ে চারটি সংবাদ প্রকাশ করতে পারে, সেই একই সংবাদপত্র ২৩ এপ্রিলের হরতাল নিয়ে কিভাবে একটা সংবাদও প্রকাশ করতে পারে না? এর মধ্যে যদি কোন রহস্য থেকে থাকে, তাহলে তা উদ্ধারের ভার সচেতন পাঠকের হাতে ছেড়ে দেয়া হলো।কৌতুহলী মনে এরপর আমাদের দেশের আরেকটি বহুল প্রচারিত জাতীয় ইংরেজি দৈনিকের অনলাইন আর্কাইভে অনুসন্ধান করা হলো।সেখানেও ২৩ এপ্রিলের হরতাল বা ১৬ মার্চে বাঙ্গালী অপহরণ সংক্রান্ত কিছু খুঁজে পাওয়া গেলো না। ফলে কৌতুহলের সাথে যোগ হলো বিস্ময়। যতটা না কৌতুহলী তার চেয়ে অনেক বেশী বিস্মিত হয়ে, বিভিন্ন সংবাদপত্রের অনলাইন সংস্করণগুলোতে অনুসন্ধান শুরু করা হলো।চরম বিস্ময়ের সাথে দেখা গেলো যে, অনেক সংবাদপত্রেই খাগড়াছড়ির তিন বাঙ্গালীর অপহরণ এবং এর অপহরণের প্রতিবাদের বাঙ্গালী সংগঠনের ডাকা হরতালের পুরো ঘটনাগূলোই প্রকাশিত হয়নি। অপরপক্ষে, তাদের বেশিরভাগই দুই পাহাড়ি নেত্রীর অপহরণ এবং অপহরণের প্রতিবাদে পাহাড়ি সংগঠনগুলোর ডাকা অবরোধের সংবাদ প্রকাশ করেছে।বিশ্বাসযোগ্য কারণ রয়েছে যে, এমন ঘটনা আরো রয়েছে, প্রতিনিয়তই আমাদের সমাজে ঘটে চলেছে। আর যথারীতি, দেশবাসী হয়ত তা দেখতে ব্যর্থও হচ্ছেন। এতকিছুর পরেও মনে হয় সংবাদপত্র বা সাংবাদিকদের বিশ্বাস করার যুক্তি সঙ্গত কারণও রয়েছে। একজন বা দু’জন সাংবাদিক কিংবা একটি বা দুটি সংবাদপত্র অথবা একটি বা দুটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে সারা জীবনের বিশ্বাস ভঙ্গ করা ঠিক হবে না। এ বিশ্বাস নিতান্তই ব্যাক্তিগত । ভিন্নমত পোষণকারী থাকতেই পারেন।আমাদের শিক্ষা বলে, মানুষ তথ্যের দ্বারা যতটা প্রভাবিত হয়, তার চেয়ে প্রভাবিত হয় একই তথ্যের উপস্থাপনায়। আমাদের এই সমাজে আমরা মানুষ হিসেবে কিভাবে নিজেদের গড়ে তুলবো এবং আমাদের সমাজ ও বিশ্বের ব্যাপারে আমাদের উপলব্ধি কেমন হবে – তা অনেকাংশে নির্ভর করে তথ্য কিভাবে তৈরি করা হয়, কোন তথ্য জোর দেওয়া হয় এবং কীভাবে বিতরণ করা হয় তার ওপর। তাই সাংবাদিকতার যত ধরণ আছে, প্রিন্ট, রেডিও টেলিভিশন, এবং ইন্টারনেট – সবই আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং নৈতিকতাকে প্রভাবিত যেমন করে, তেমনি প্রকাশ করে অন্যের নৈতিকতার মানদণ্ডও।লিখেছেনঃ-(মাহের ইসলাম,পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক গবেষক)।

ট্যাগ :

আরো সংবাদ

ফেইসবুকে আমরা



আর্কাইভ
May 2024
M T W T F S S
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
282930  
আলোচিত খবর

error: কি ব্যাপার মামা !!