কেউ গৃহহীন থাকবে না ॥ কক্সবাজারে বিশ্বের বৃহত্তম জলবায়ু উদ্বাস্তু কেন্দ্র উদ্বোধন


অনলাইন ডেস্ক প্রকাশের সময় :২৪ জুলাই, ২০২০ ৫:৫৫ : অপরাহ্ণ 349 Views

কক্সবাজারকে উন্নত পর্যটন নগরী হিসেবে গড়ে তোলা হবে। বিশ্বের মানুষ যাতে এর সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন। সে লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার। দেশের কোন মানুষ গৃহহীন থাকবে না। শুধু এখানে বলে না, সারা বাংলাদেশেই আমরা কোথায় গৃহহীন, ভূমিহীন মানুষ আছে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নিচ্ছি। গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বক্তব্য প্রদানকালে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের রাজনীতি হচ্ছে অসহায় মানুষের জন্য। বাংলাদেশে কোন মানুষ যেন ঘরছাড়া না থাকে, সেটা দেখার দায়িত্ব আমাদের। তারই অংশ হিসেবে এই আশ্রয়ণ প্রকল্প। এটা শুরু হয়েছে, এখানে আরও মানুষের আশ্রয়স্থল করা হবে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

দৃষ্টিনন্দন এই প্রকল্পের প্রশংসা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি খুরুশকুল দেখতে যাব, শুঁটকি ভর্তা দিয়ে ভাত খাব’। জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য কক্সবাজার সদরের খুরুশকুলে নির্মিত বিশ্বের সর্ববৃহৎ আশ্রয়ণ প্রকল্প উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমন অনুভূতি প্রকাশ করেন। এ সময় উপস্থিত স্থানীয় বাসিন্দারা প্রধানমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানান। বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা ২০ মিনিটের দিকে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হয়ে জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য নির্মিত বিশে^র সর্ববৃহৎ জলবায়ু আশ্রয়ণ কেন্দ্র উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে বাস্তবায়িত হচ্ছে এই প্রকল্প। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন। অনুষ্ঠান থেকে প্রধানমন্ত্রী এই আশ্রয়ণ কেন্দ্র উদ্বোধনের পর ১৯ জন উপকারভোগীর মাঝে বসতঘরের চাবি হস্তান্তর করা হয়। এ সময় খুরুশকুল প্রান্তে তিনজন উপকারভোগী আশ্রয়ণ প্রকল্পস্থলে ফলদ, বনজ ও ঔষধি গাছের চারা রোপণ করেন। ১৪ জুলাই লটারির মাধ্যমে নির্বাচিত হন ওই ১৯ পরিবার। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে প্রথমিকভাবে ৬০০ পরিবারকে আবাসন বুঝিয়ে দেয়া হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে ১৮০০ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রথম ধাপে নির্মিত পাঁচতলা ২০টি ভবনসহ প্রকল্পের মোট ১৩৯টি ভবন নির্মাণ করা হবে। প্রতিটি পাঁচতলা ভবনে থাকছে ৪৫৬ বর্গফুট আয়তনের ৩২টি করে ফ্ল্যাট। একটি থাকবে ১০ তলা শেখ হাসিনা টাওয়ার। সব ভবন নির্মিত হলে উদ্বাস্তু জীবনের অস্বাস্থ্যকর, নোংরা পরিবেশ ছেড়ে সাজানো পরিপাটি দালানে উঠবেন মোট প্রায় সাড়ে ৪ হাজার পরিবার। ১০০১ টাকা নামমাত্র মূল্যে এসব ফ্ল্যাট হস্তান্তর করা হবে। খুরুশকুলে বাঁকখালী নদীর তীরে ২৫৩ একর জমির ওপর গড়ে ওঠা এ বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্প জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে বড় আশ্রয় কেন্দ্র বলেও জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

গণভবন প্রান্তে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন- প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব মোঃ তোফাজ্জল হোসেন মিয়াসহ উর্ধতন কর্মকর্তারা। কক্সবাজার প্রান্তে উপস্থিত ছিলেন চকরিয়া-পেকুয়া আসনের সংসদ সদস্য জাফর আলম, মহেশখালী-কুতুবদিয়া আসনের আশেক উল্লাহ রফিক, সদর-রামু আসনের সংসদ সদস্য সাইমুম সরওয়ার কমল, উখিয়া-টেকনাফ আসনের সংসদ সদস্য শাহীন আকতার, খুরুশকুল আশ্রয়ণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) মাহবুব হোসেন, চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার এবিএম আজাদ এনডিসি, সেনাবাহিনীর দশম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি এবং এরিয়া কমান্ডার মোঃ মাঈন উল্লাহ চৌধুরী, কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মোঃ কামাল হোসেন, পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ্যাডভোকেট সিরাজুল মোস্তফা, সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত ছিলেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে খুরুশকুলের চেহারা বদলে যাবে। এখানে স্কুল, মসজিদ, মাদ্রাসা, গির্জা ও প্যাগোডা গড়ে উঠবে। দেশের একটি মানুষও ঘরছাড়া থাকবে না, মুজিববর্ষে এটা হলো আমাদের প্রতিশ্রুতি। আজ ৬০০ উদ্বাস্তু পরিবারকে ফ্ল্যাটের চাবি হস্তান্তর করা হলো। বাকি যারা আছেন তারাও পর্যায়ক্রমে ফ্ল্যাট পাবেন। যে ঘরবাড়িগুলো করে দিলাম সেগুলো যতœ করে রাখবেন। এ ফ্ল্যাটগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ করবেন। পরিবেশ বজায় রাখবেন। পর্যাপ্ত গাছ লাগাবেন। এখানে পুকুর কাটা হয়েছে। করা হয়েছে সুপেয় পানির ব্যবস্থা। পুলিশ ফাঁড়ি করা হয়েছে। এছাড়া এখানে যারা বসবাস করবেন তারা অধিকাংশই মৎস্যজীবী। তারা যেন মাছ ধরে শুঁটকি করতে পারে এবং এখানে যেন শুঁটকির বিশাল একটি বাজার গড়ে ওঠে সে ব্যবস্থা আমরা করব। এখানে এমন নয়নাভিরাম দৃশ্য করা হবে, যেন পর্যটকরা ওই এলাকায় আসে এবং শুঁটকি কিনতে পারে।

চলমান বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, দেশে বর্তমানে বন্যা চলছে। বন্যা মোকাবেলা করার প্রস্তুতি আমাদের আছে। এবার বন্যার প্রকোপটা একটু বেশি দেখা যাচ্ছে। শ্রাবণ ও ভাদ্র মাসের দিকে আরও পানি আসবে। অর্থাৎ আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আরও বন্যা হওয়ার আশঙ্কা থাকতে পারে। বন্যায় ও নদী ভাঙ্গনে যারা গৃহহারা হচ্ছেন তাদেরও ঘরবাড়ি করে জীবন-যাপনের ব্যবস্থা করে দেয়া হবে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, বাজেটে আমরা আলাদাভাবে টাকাই রেখে দিয়েছি গৃহহীন মানুষের ঘর করে দেয়ার জন্য। যাতে একটি মানুষও গৃহহারা না থাকে।

তিনি বলেন, আমরা জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন করছি। জাতির পিতার স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশ হবে ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ। আমরা জাতির পিতার সেই স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে যাচ্ছি। আমরা আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে যেমন ঘর করে দিচ্ছি পাশাপাশি যাদের জমি আছে তাদের ঘর করে দেয়ার জন্য গৃহায়ন তহবিল নামে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটা তহবিল করা আছে সেখান থেকে যেকোন প্রতিষ্ঠান টাকা নিয়ে ঘর করতে পারে। আর আমরা নিজেরাও আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমেও যাদের জমি আছে, ভিটা আছে কিন্তু ঘর নেই তাদের ঘর করে দিচ্ছি।

ভিডিও কনফারেন্সে জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি এ্যাডভোকেট সিরাজুল মোস্তফা বলেন, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি কক্সবাজার। বাঁকখালী নদীর তীরে আপনার সুন্দর এবং অনন্য চিন্তাধারা, একটি সফল সৃষ্টি এই আশ্রয়ণ প্রকল্প। সুন্দর চিন্তা ভাবনা ছিল বলেই এ ধরনের সুন্দর পরিকল্পনা করা আপনার পক্ষে সম্ভব হয়েছে। উপকারভোগীরা সবাই আনন্দিত। কক্সবাজারবাসী খুবই আনন্দিত ও কৃতজ্ঞ।

জেলা প্রশাসক মোঃ কামাল হোসেন বলেন, ১৯৯১ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে উদ্বাস্তু হওয়া লোকজনের জন্যই এই প্রকল্প। খুরুশকুল আশ্রয়ণ প্রকল্পে যাদের পুনর্বাসিত করা হচ্ছে, তারা সবাই কক্সবাজার পৌরসভার ১নং ওয়ার্ডের কুতুবদিয়াপাড়া ও সমিতিপাড়ার বাসিন্দা। বিমানবন্দর সম্প্রসারণের কারণে ক্ষতিগ্রস্তরা যাতে আশ্রয়হীন হয়ে না পড়ে, তার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেন। খুরুশকুল আশ্রয়ণ প্রকল্পটিকে মূল শহরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের জন্য ব্রিজ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কস্তুরাঘাট এলাকা হয়ে বাঁকখালী নদীর ওপর নির্মাণ করা হচ্ছে ৫৯৫.০০ মিটার ব্রিজ। যার প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ২০০ কোটি টাকা। প্রকল্পটিতে বহুমুখী যাতায়াত ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর মধ্যে জেটিঘাট হতে অফিস পর্যন্ত এইচবিবি রাস্তা নির্মাণ, কৃষ্টের দোকান থেকে সালেহ আহমেদ কোম্পানি পর্যন্ত এইচবিবি রাস্তা নির্মাণ, জয়নাল আবেদীন সংযোগ সড়ক নির্মাণ। ৪ হাজার ৪০৯টি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার যাতে নিরাপদে পানি ব্যবহার করতে পারে তারও ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এজন্য বৃহৎ প্রকল্প গ্রহণ করে জনস্বাস্থ্য অধিদফতরের মাধ্যমে। যার লক্ষ্য পাম্প হাউস ও পানি সরবরাহ লাইন স্থাপন।

উদ্বোধন শেষে প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সে উপকারভোগীদের সঙ্গে কথা বলেন। এতদিন বস্তির ঝুপড়ি ঘরে কষ্টের জীবন শেষে দালানে উঠতে পেরে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন তারা। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন তারা। এ আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান উপকারভোগীরা। স্থানীয় ভাষায় একজন শিল্পী গানে গানে প্রধানমন্ত্রীকে ‘মহেশখালীর পানর খিলি বানায়’ খাওয়ানোর আমন্ত্রণ জানান।

ট্যাগ :

আরো সংবাদ

ফেইসবুকে আমরা



আর্কাইভ
July 2024
M T W T F S S
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
30  
আলোচিত খবর

error: কি ব্যাপার মামা !!