ওবায়দুল কবির ॥ ২০০১ সালের ৪ জুলাই, বুধবার। আষাঢ়ের শেষ বিকেলে বৃষ্টি ছিলনা। আকাশে ছিল ছেঁড়া মেঘ আর ভূমিতে প্রচণ্ড তাপপ্রবাহ। এর মধ্যেও হাজার হাজার মানুষ এসেছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এক অসম্ভব স্বপ্নযাত্রার সাক্ষী হতে। পদ্মা সেতুর র্ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন তিনি। অসম্ভব মনে হচ্ছিল তখন অনেকের কাছেই। কেউ বলেছিলেন এটি শুধুই নির্বাচনী ঘোষণা। কারও মনে হয়েছিল স্বপ্নবিলাসী রাষ্ট্রনায়কের অলিক চিন্তা। আজ প্রায় বিশ বছর পর সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন গোটা বাঙালী জাতিকে উন্নীত করেছে কয়েক ধাপ উঁচুতে।
স্বপ্ন দেখার সেই দিনে কয়েক হাজার মানুষের মধ্যে আমিসহ ঢাকার বেশ কিছু সাংবাদিকও ছিলেন সাক্ষী। প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে সেদিন এই ঐতিহাসিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করতে পেরেছিলাম আমরা। তারপর বিশ বছর অনেক ঘটনা, ষড়যন্ত্র এবং সাহসী এক রাষ্ট্রনায়কের লড়াই একজন সংবাদকর্মী হিসাবে প্রত্যক্ষ করেছি খুব কাছ থেকে। জাতির জনকের স্বপ্ন যেমন স্বাধীন বাংলাদেশ, তেমননি তার কন্যা শেখ হাসিনার স্বপ্ন এই পদ্মা সেতু। এজন্য তাকেও পাড়ি দিতে হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর মতো দীর্ঘ এবং কণ্টকাকীর্ণ পথ। তবুও তিনি আজ সফল। তার সঙ্গে সঙ্গে স্বপ্ন পূরণ হয়েছে দেশের ১৭ কোটি মানুষের।
তখন দেশে নির্বাচনের ডামাডোল। মাত্র কয়েকদিন পরই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন শেখ হাসিনার নেতৃত্বের আওয়ামী লীগ সরকার। চার দিকে জল্পনা কল্পনা- কে হচ্ছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান। কারা হচ্ছেন এই সরকারের উপদেষ্টা। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবউদ্দীন আহমেদকে ১৫ জুলাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শপথ নেয়ার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। একই সঙ্গে তিনি ১৩ জুলাই পর্যন্ত সংসদের পূর্ণ মেয়াদ অধিবেশন চালানোর ঘোষণা দেন। সেদিন তিনি বলেছিলেন, মেয়াদের শেষ সময় পর্যন্ত একটি সরকারের ক্ষমতায় থাকা এক দিকে যেমন ইতিহাস, অন্য দিকে এটি ভবিষ্যতের জন্য নজির (কনভেনশন) হয়ে থাকবে। বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট তখন নানা অজুহাতে আন্দোলনের চেষ্টা করছে। এমন এক উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন। শুরুতে অর্থের সংস্থান ছিলনা। প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী শেখ হাসিনা সেদিন বলেছিলেন, শীঘ্রই অর্থের সংস্থান করে সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হবে। সে সুযোগ তিনি আর পাননি। পহেলা অক্টোবর নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বে চার দলীয় জোট ক্ষমতা এসে সবকিছু ভেস্তে দেয়। অর্থ জোগাড় করে সেতু নির্মাণ কাজ শুরু করতে শেখ হাসিনাকে দীর্ঘ ১৪ বছর অপেক্ষা করতে হয়।
সেদিন যোগাযোগমন্ত্রী ছিলেন আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। প্রাক সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে সেতুর দৈর্ঘ্য নির্ধারণ করা হয় ৬ দশমিক ৩ কিলোমিটার। সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছিল সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। সেতুর বাস্তবায়ন কাল ধরা হয়েছিল ২০০৮। সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয় মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তের পুরনো ফেরিঘাটে। সেখানে সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা শেষে প্রধানমন্ত্রী চলে যান দুই কিলোমিটার দূরে কুমারভোগ চন্দ্রের মাঠে স্থানীয় আওয়ামী লীগ আয়োজিত এক বিশাল সমাবেশে। মোহাম্মদ মহিউদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে সেই জনসভায় বক্তৃতা করেছিলেন সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, আমির হোসেন আমু, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদসহ কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতৃবৃন্দ।
ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, জাপান সফরের সময় সেদেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমি বাংলাদেশে দুটি সেতুতে অর্থ বরাদ্দের অনুরোধ জানিয়েছি। একটি রূপসা এবং অপরটি পদ্মা। এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক পদ্মা সেতুর প্রাক সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের অর্থ দিয়েছে। জাপান সরকারও অর্থের সংস্থানে আশ্বাস দিয়েছে। দুটি সাহায্য এখন আমাদের হাতে আছে। বাকি টাকাও সংস্থান হয়ে যাবে। ক্ষমতার বদলে সেদিন আর তার অর্থ জোগাড় করা হয়ে উঠেনি। নির্বাচনী প্রচারে বিএনপির নেতারা দাবি করেন, পদ্মা সেতু শুধু আওয়ামী লীগের নির্বাচনী স্ট্যান্ডবাজি। এর কোন কাজই তারা করে যায়নি।
বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট ক্ষমতায় বসে পদ্মা সেতু নিয়ে নানা ঘটনার জন্ম দেয়। তৎকালীন যোগাযোগ মন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার নানা ধরনের উষ্মা এবং বাঁকা বক্তব্য পদ্মা সেতুর ভবিষ্যত নিয়ে মানুষের মনে সন্দেহ দেখা দেয়। এক পর্যায়ে শুরু হয় সেতুর স্থান নিয়ে বিতর্ক। শেখ হাসিনা যে স্থানে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন সে স্থানে সেতু নির্মাণ সম্ভব নয় বলে একটি মত নিয়ে বিতর্কের জন্ম দেন স্বয়ং যোগাযোগ মন্ত্রী। এ নিয়ে চলে নানামুখী আলোচনা। ক্ষমতার পাঁচ বছর অর্থ জোগাড় দূরের কথা সেতুর স্থানই নির্ধারণ করতে পারেনি চারদলীয় জোট সরকার।
সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শেষ সময় আবারও পদ্মা সেতু নির্মাণে উদ্যোগ নেয়া হয়। তারাও খুব একটা এগুতে পারেননি। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবারও উদ্যোগ নেন তার স্বপ্ন বাস্তবায়নে। সেতুর অর্থায়নে চুক্তি হয় বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে। শুরু হয় ষড়যন্ত্র। ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার লাভ করে বিশ্বব্যাংক পর্যন্ত। অভিযোগ ওঠে সেতু নির্মাণে দুর্নীতির। ২০১৩-২০১৪ সাল শেষ হয় এই দুর্নীতি বিতর্কে। শেষ পর্যন্ত পদ্মা সেতুর অর্থায়ন প্রত্যাহার করে নেয় বিশ্বব্যাংক। একই সঙ্গে অর্থ প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয় অন্য উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলো। তৈরি হয় সঙ্কট। অভিযোগের প্রেক্ষিতে সরিয়ে দেয়া হয় তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে। আওয়ামী লীগ সরকারের টালমাটাল অবস্থা। আবারও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী সিদ্ধান্ত। তিনি জোর দিয়ে বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণ কার্যক্রমে কোথাও দুর্নীতি হয়নি। তিনি এও বলেন, এই ষড়যন্ত্র একদিন উন্মোচিত হবে। একই সঙ্গে তিনি ঘোষণা দেন, পদ্মা সেতু অবশ্যই হবে এবং তা হবে নিজস্ব অর্থায়নে। কারও সাহায্যের প্রয়োজন নেই। সেদিন মানুষ দেখেছিল এক আত্মবিশ্বাসী মানুষের সাহসী রূপ।
শেখ হাসিনার এই সিদ্ধান্তে হতবাক হয়েছিল দেশের মানুষ। বিশ্বব্যাংক-আইএমএফসহ সকল দাতা সংস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে কিভাবে এমন সাহসী সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। কিছুটা হতবাক এবং বিস্মিত তার নিজ দলের নেতারাও। শেখ হাসিনা আর পেছন ফিরে তাকাননি। মানুষের ওপর অতিরিক্ত করের বোঝা না চাপিয়ে, কারও কাছ থেকে কোন সহযোগিতা না নিয়ে দেশের নিজস্ব সম্পদ থেকে অর্থায়নের মাধ্যমে চলতে থাকে পদ্মা সেতুর কাজ। ২০১৭ সালে সেতুর কাজ অনেকটা দৃশ্যমান হলে মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করে যে পদ্মা সেতু হচ্ছে। খুলে যায় অনেক জট। কানাডার আদালতে চলমান মামলায় রায় বের হয়। রায়ে বলা হয়, পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। সমালোচনাকারীদের মুখে ছাই দিয়ে ষড়যন্ত্রের সকল জাল ছিন্ন করে পদ্মা সেতু আজ বাস্তবতা। এক স্বপ্নচারী রাষ্ট্রনায়কের সাহসী সিদ্ধান্ত আজ গোটাটাই দৃশ্যমান। এখন শুধু অপেক্ষা সেতু দিয়ে ট্রেন এবং যানবাহন চলাচলের দৃশ্য দেখার।