আদিবাসী বনাম উপজাতি বিতর্ক


প্রকাশের সময় :৬ আগস্ট, ২০১৭ ১১:০৯ : অপরাহ্ণ 880 Views

সিএইচটি টাইমস নিউজ ডেস্কঃ- আগস্ট মাস এলেই বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নেতারা সোচ্চার হয়ে ওঠেন। নিজেদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে গণ্য করার জন্য দাবি জানাতে থাকেন।বাংলাদেশ সংবিধানের ২৩(ক) অনুচ্ছেদে বর্ণিত দেশের ‘উপজাতি,ক্ষুদ্র জাতিসত্তা,নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়’-এর জন্য সরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে চাকরির ক্ষেত্রে এবং বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য কোটা সুবিধা রয়েছে।এসব সুবিধাভোগী গত কয়েক বছর ধরে ‘আদিবাসী ফোরাম’ নামের সংগঠন থেকে ৯ আগস্ট বিশ্ব আদিবাসী দিবস পালনের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসছেন।পক্ষান্তরে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে ‘আদিবাসী’ শব্দটি না থাকায় বিভিন্ন জেলা প্রশাসকের কাছে স্থানীয় সরকার, পল্লি উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো চিঠিতে বিশ্ব আদিবাসী দিবস উদযাপনে সরকারের কোনো পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ত না হওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়। সংবিধানের ‘উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়’ শব্দগুলোর পরিবর্তে আদিবাসী ফোরামের দাবি এখানে ‘আদিবাসী জাতিসমূহ’ সংযুক্ত করা হোক। বর্তমান সরকার ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষর করেছে এবং তা বাস্তবায়নে সচেষ্ট। অথচ পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু) লারমা নানা বক্তব্য ও মন্তব্যে অসহযোগিতার মনোভাব প্রকাশ করে আসছেন।

‘আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকারবিষয়ক জাতিসংঘ ঘোষণাপত্র ২০০৭’ অনুসারে তাদের ৪৬টি অধিকারের কথা লিপিবদ্ধ হয়েছে। এই ঘোষণাপত্রে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর সংজ্ঞা নির্ধারিত হয়নি বা সুস্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত হয়নি। তাছাড়া ঘোষণাপত্রের ওপর সব সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে সর্বসম্মত সমর্থন নেই। এ কারণে বাংলাদেশ আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকারবিষয়ক ঘোষণাপত্রের ওপর ভোট গ্রহণের সময় তারা ভোটদানে বিরত ছিল। তবে যেকোনো অনগ্রসর জাতিগোষ্ঠীর অধিকারের প্রতি সমর্থন রয়েছে সরকারের। সংবিধান অনুসারে সরকারপ্রধান মানবাধিকার চুক্তির প্রতি অনুগত এবং উপজাতিদের অধিকার সমর্থন করে আসছে। উল্লেখ্য, ‘আদিবাসী’ শব্দটি সংবিধানে সংযোজিত হলে ২০০৭ সালের ‘আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকারবিষয়ক জাতিসংঘ ঘোষণাপত্র’ মেনে নিতে হবে; যা হবে বাংলাদেশের জন্য আত্মঘাতী। কারণ ঘোষণাপত্রের অনুচ্ছেদ-৪-এ আছে : ‘আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার চর্চার বেলায়, তাদের অভ্যন্তরীণ ও স্থানীয় বিষয়ের ক্ষেত্রে স্বায়ত্তশাসন এবং স্বশাসিত সরকারের অধিকার রয়েছে ও তাদের স্বশাসনের কার্যাবলির জন্য অর্থায়নের পন্থা এবং উৎসের ক্ষেত্রেও অনুরূপ অধিকার রয়েছে।’ অর্থাৎ ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করলে ও পার্বত্য অঞ্চলে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠিত হলে তাদের অনুমতি ছাড়া বাংলাদেশ সরকার খাগড়াছড়ির গ্যাস উত্তোলন করে অন্য জেলায় আনতে পারত না। কারণ সেখানকার স্বশাসিত আদিবাসী শাসক নিজেদের অর্থায়নের উৎস হিসেবে সেই খনিজ, বনজ ও অন্যান্য সম্পদ নিজেদের বলে চিন্তা করত। আবার অনুচ্ছেদ-৩৬-এ আছে, ‘আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর, বিশেষত যারা আন্তর্জাতিক সীমানা দ্বারা বিভক্ত হয়েছে, তাদের অন্য প্রান্তের নিজস্ব জনগোষ্ঠীর সঙ্গে আধ্যাত্মিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক কার্যক্রমসহ যোগাযোগ সম্পর্ক ও সহযোগিতা বজায় রাখার ও উন্নয়নের অধিকার রয়েছে।’ রাষ্ট্র এই অধিকার কার্যকরে সহযোগিতা প্রদান ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করবে। ঘোষণাপত্রের এই নির্দেশ কোনো সরকারই মেনে নিতে পারবে না। কারণ পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের সঙ্গে রাজনৈতিক কার্যক্রম অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হবে। তাছাড়া বাংলাদেশে পার্বত্য অঞ্চলের সীমান্তবর্তী এলাকায় জঙ্গি তৎপরতা বৃদ্ধি পাবে; যা ক্রমেই সরকারের মাথাব্যথার কারণ হয়ে জাতীয় উন্নয়ন ব্যাহত করবে। জাতিসংঘের এই ঘোষণাপত্রের শেষ অনুচ্ছেদ-৪৬-এ সবার মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতার প্রতি সম্মান দেখানোর কথা বলা হয়েছে এবং এই কাজটি বর্তমান মহাজোট সরকার সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সম্পন্ন করেছে। এর আগে ‘পার্বত্য শান্তিচুক্তি’ অনুসারে ন্যায়বিচার, গণতন্ত্র, মানবাধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, সমতা, বৈষম্যহীনতা, সুশাসন এবং সরল বিশ্বাসের মূলনীতি অনুসরণ করা হয়েছে।

জাতিসংঘের ঘোষণাপত্রের একাধিক অনুচ্ছেদ অনুসারে আদিবাসীদের কোনো অধিকার চর্চার ক্ষেত্রে বৈষম্য করা যাবে না। এক্ষেত্রে শিক্ষা, চাকরি ও অন্যান্য বিষয়ে বাঙালিদের মতো তাদেরও সমান সুযোগ দিতে বাধ্য থাকবে রাষ্ট্র। এর আরেক ধরনের ব্যাখ্যা দেওয়া যেতে পারে, উপজাতিদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে চিহ্নিত করলে কোটা সুবিধা বাতিল অনিবার্য হয়ে পড়বে। ফলে তাদের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হবে। সেক্ষেত্রে বাঙালি-উপজাতি সম্পর্কের মধ্যে বিরূপ ধারণা জন্ম নিতে পারে। মনে রাখা দরকার, এই ঘোষণাপত্রের বিপক্ষে ভোট দিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ড ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এসব দেশে বিপুলসংখ্যক নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীর বসতি রয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভোটদানে বিরত ছিল রাশিয়া, ভুটান, নাইজেরিয়া, কেনিয়া, ইউক্রেন, কলম্বিয়া প্রভৃতি দেশ। অনুপস্থিত ছিল আরও অনেক উন্নত দেশ। উল্লেখ্য, ভারতে বসবাসকারী একই সম্প্রদায়ভুক্ত উপজাতিদের সেখানকার সংবিধানে ‘আদিবাসী’ হিসেবে সম্বোধন করা হয়নি। বলা হয়েছে- ঝপযবফঁষবফ ঈধংঃব ধহফ ঝপযবফঁষবফ ঞৎরনবং। সংবিধানে আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা এবং মিজোরামকে উপজাতি অধ্যুষিত রাষ্ট্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাদের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৯(১)(২), ৩০(১)(১এ), ৪৬, ২৪৪(১) ২৪৪এ(১), ৩৩২(১), ৩৩৫, পঞ্চম অধ্যায়, পার্ট বি, অনুচ্ছেদ-৪ এবং ষষ্ঠ অধ্যায়ের অনুচ্ছেদ-১-এর অংশগুলোর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী তথা উপজাতিগুলোর উন্নয়নে অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়ে ১৯৭২ সালের ২২ জুন আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ওখঙ) প্রণীত ‘ইন্ডিজেনাস অ্যান্ড ট্রাইবাল পপুলেশনস কনভেনশন, ১৯৫৭’ (কনভেনশন নম্বর ১০৭)-এ অনুস্বাক্ষর করেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নৃ-তাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠী এবং ট্রাইবাল জাতিগোষ্ঠীর আত্মপরিচয়সহ তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার রক্ষার জন্য জাতিসংঘের এই সংস্থাটি আবার সংশোধিত ‘ইন্ডিজেনাস অ্যান্ড ট্রাইবাল পপুলেশনস কনভেনশন ১৯৮৯’ (কনভেনশন নম্বর ১৬৯) গ্রহণ করে। এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ আইনি দলিল জাতীয় পর্যায়ে উপজাতিদের অধিকারকে প্রতিষ্ঠা ও কার্যকর করার জন্য প্রয়োজনীয়। এখানে ট্রাইবাল বা সেমি-ট্রাইবাল বলতে ওই গোষ্ঠী ও ব্যক্তিদের বোঝানো হয়েছে, যারা তাদের ট্রাইবাল বৈশিষ্ট্য হারানোর প্রক্রিয়ায় রয়েছে এবং এখনো জাতীয় জনসমষ্টির সঙ্গে একীভূত হয়নি। বঙ্গবন্ধুর অনুসৃত পথে অগ্রসর হয়ে বর্তমান সরকার পার্বত্য শান্তিচুক্তির মাধ্যমে পাহাড়ি অধিবাসীদের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। পার্বত্য অঞ্চলে পুরো বাংলাদেশের জনগণের মাত্র ০.৫ শতাংশ উপজাতির বাস। এই উপজাতিরা দেশের এক-দশমাংশ ভূখ-ের অধিকারী। মহাজোট তথা শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতায় আসার পর পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান নিয়োগ করা হয়েছে। ভূমি কমিশন গঠন ও ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান বিল ২০১০’ জাতীয় সংসদে গৃহীত হয়েছে। দেশের অখ-তা রক্ষার জন্য উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের ধারণা সবাই মেনে নেবে বলেই আমাদের বিশ্বাস।

লেখক:-অধ্যাপক,বাংলা বিভাগ,জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পাদনা:-আশিক রহমান
(((আমাদের অর্থনীতি)))

ট্যাগ :

আরো সংবাদ

ফেইসবুকে আমরা



আর্কাইভ
July 2025
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
2930  
আলোচিত খবর

error: কি ব্যাপার মামা !!