ডিপোর সিলগালা খুলে স্টেশনেই তেল চুরির মহোৎসব


সিএইচটি টাইমস অনলাইন প্রকাশের সময় :১৫ অক্টোবর, ২০১৯ ১১:১০ : অপরাহ্ণ 549 Views

আধুনিকতার ছোঁয়ায় পাল্টে গেছে খুলনা রেলস্টেশনের বাহ্যিক রূপ। তবে রেলের তেল চুরি, টিকেট কালোবাজারী, মাদকের আখড়া যেন ওপেন সিক্রেট। সেবার মান নিয়েও অভিযোগ রয়েছে যাত্রীদের।

জানা গেছে, রেলওয়ের তেল চুরির কারবার চলে পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা ডিপো থেকে আনা ওয়াগান থেকে। এসব ওয়াগানের মাধ্যমে খুলনা থেকে পার্বতীপুর ডিপোতে তেল পরিবহণ করা হয়। তেল ডিপো থেকে এনে যারা জংশনে বুঝিয়ে দেয়, তারাই এই পাচারের সঙ্গে জড়িত। আর জংশনে আসা তেল ভর্তি ওয়াগানকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে বিশাল চুরির সিন্ডিকেট। এখানে ডিপো থেকে করা সিলগালা খুলে তেল বের করে পুনরায় হুবহু ডিপোর সীলগালা করা হয়। এরা সব পক্ষকে ম্যানেজ করে তেল চুরি চালিয়ে যাচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অবৈধ চোরাই তেলের কারবার হয় মূলত তিনটি পয়েন্টে। এগুলো হচ্ছে খুলনা রেলওয়ের স্টেশন, জংশন ও কাশিপুর তেল ডিপো। এছাড়া দৌলতপুর ও ফুলতলার বেজেরডাঙ্গায় রেল থামিয়ে তেল বিক্রি করা হয়।

তেল চুরি কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত রেলওয়ের আরএনবি-নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য বাদল সরদার, শফিকুল ইসলাম সোহাগ ও সোহেল। তেল চুরিতে এদের সহযোগিতা করে আরএনবি-নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য মানিক হোসেন, ওয়াছকরোনী, মাসুদ খাঁন ও শামীম। আরো আছেন লোকো বিভাগের উজ্জ্বল, কুদরত ও হেদায়েত। লোকো ইন্সপেক্টর (এলআই) মীর ইদ্রিস আলী তেল চুরিতে কার্যত এদের সহযোগিতা করে থাকে বলে অভিযোগ রয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে লোকো ইন্সপেক্টর (এলআই) মীর ইদ্রিস আলী উত্তেজিত কণ্ঠে বলেন, আমার দায়িত্ব পড়ে দুর্ঘটনায় পতিত ট্রেনের স্থানে, তেল এর স্থানে নয়। পক্ষান্তরে রেলওয়ের সরকারি তেল জমা-খরচের হিসাব দিতে হয় তার, এমন কথাও স্বীকার করেন তিনি।

খুলনা রেলওয়ে স্টেশনের সরকারি তেল চুরির তথ্যের ভিত্তিতে রেলস্টেশনে অভিযান চালায় র‌্যাব। এসময় তেল চুরির সঙ্গে জড়িত ৫ নং ঘাট এলাকার মোতালেব হাওলাদারের ছেলে সজল হাওলাদার ও আব্দুল খালেকের ছেলে মো. মালেককে আটক করা হয়।

র‌্যাবের অভিযানের পরেও কোনো পরিবর্তন আসেনি। প্রতিদিনই চুরি হচ্ছে রেলের তেল। তবে আগের মত হরহামেশা না হলেও কৌশল পাল্টেছে তেল চুরির সিন্ডিকেট। বর্তমানে প্রতিদিন প্রায় দুই হাজার লিটার তেল চুরি হচ্ছে শুধু খুলনা স্টেশন থেকেই এমন অভিযোগ রয়েছে।

খুলনায় রেলের পরিত্যক্ত ওয়াগনগুলোতে মাদক সেবন ও জুয়া খেলার নিরাপদ আড্ডাস্থলে পরিণত হয়েছে। খুলনা রেল স্টেশনে দীর্ঘদিন ধরে পড়ে রয়েছে কোটি কোটি টাকা মূল্যের পরিত্যক্ত ওয়াগন। এসব ওয়াগনগুলো উন্মুক্ত ও নিরাপত্তা কম থাকায় খুব সহজেই এসব স্থানে মাদক বিকিকিনি ও জুয়ার আসর বসছে। বিষয়টি নিয়ে খোদ বিব্রত খুলনা অঞ্চলের রেলওয়ের নিরাপত্তা শাখা।

অভিযোগ রয়েছে, রেলস্টেশনের আশে পাশের বস্তি এলাকা ও মিল-কারখানার লোকজন এসকল অপরাধের সঙ্গে জড়িত।

খুলনা অঞ্চলের রেলওয়ে ওয়াগনের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সিআই সরদার রফিকুল ইসলাম বলেন, জনবল সংকট চলছে দীর্ঘদিন ধরে। এরিয়া অনুযায়ী জনবল খুবই অপ্রতুল। তবে ওয়াগনগুলো দেখাশুনার জন্য লোকজন থাকে সব সময়। রেলওয়ের নিরাপত্তাকর্মীরা নিরস্ত্র থাকেন। ফলে এসব দুষ্টু লোকের দেখা মিললেও কিছু করার থাকে না।

স্টেশনে নিরাপত্তার জন্য সিসি ক্যামেরা বসানোর কথা থাকলেও তা এখনো বসেনি। নিরাপত্তা না থাকায় সম্প্রতি খুলনা রেলওয়ে থানায় ঘটে লোমহর্ষকর এক ঘটনা। থানার ওসি ও চার পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে এক গৃহবধূকে গণধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। যা নিয়ে সারাদেশে আলোচনার ঝড় ওঠে। এ ঘটনায় মামলা হওয়ার পর ওসিকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে টিকেট সিন্ডিকেটের বিষয়েও। উন্নয়নের অংশ হিসেবে চালু করা হয়েছে অনলাইন টিকেট সার্ভিস। এখানেও অনিয়মের থাবা পড়তে দেরি হয়নি। খুলনা রেলওয়ে স্টেশনের টিকেট ভিআইপিদের নামে অনলাইনে ব্লক করে রাখার অভিযোগে অভিযান চালায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। পরে টিকেট কালোবাজারীর সাথে জড়িত প্রধান বুকিং সহকারী ইয়াকুব আলীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করে দুদক।

দুদকের ওই অভিযানে স্টেশন মাস্টার মানিক চন্দ্র সরকারের টেবিলের ড্রয়ারে ২২ হাজার ৯১২ টাকা পাওয়া যায়। অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীদের পেনশন থেকে এই টাকা উৎকোচ হিসেবে আদায় করা হয় বলে জানা গেছে। ওই টাকা না দিলে পেনশনের টাকা আটকে রাখা হতো।

অভিযানে প্রধান বুকিং সহকারী মেহেদী হাসানের টিকেট সিন্ডিকেটে জড়িত থাকার প্রমাণও পায় দুদক। এসময় টিকেটের বুকিং ইনচার্জ মেহেদী হাসানকে বরখাস্তের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য স্টেশন মাস্টারের কাছ থেকে লিখিত মুচলেকা নেয় দুদক। তবে তাকে বরখাস্ত না করে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে।

দুদকের অভিযানে পর খুলনা রেল স্টেশনে আবার অভিযান চালায় খুলনা জেলা প্রশাসন।সেখানে অগ্রিম টিকেট কালোবাজারে বিক্রির অভিযোগে তৌহিদুল ইসলাম নামে এক যুবক ধরা পড়লে তাকে কারাদণ্ড দেয় ভ্রাম্যমাণ আদালত। একইসঙ্গে তাকে জরিমানাও করা হয়।

যাত্রীদের অভিযোগ, পুরাতন স্টেশনের মতো ট্রেনের টিকেট বিক্রিতে এখনো জিম্মি দশা। টিকেট বিক্রি শুরু করার দুই একদিন পর থেকে কাউন্টারে টিকেট না থাকলেও ট্রেন ছাড়ার আগ মুহূর্তে বেশি দামে বিক্রি করা হয়। এখনো আগের মতো টিকেট ব্লক করে রাখে স্টেশনের ওই চক্রটি।

খুলনা স্টেশন মাস্টার মানিক চন্দ্র সরকার বলেন, টিকেট বুকিং ইনচার্জ মেহেদী হাসানের বরখাস্তের বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছিল। কিন্তু পরে তার পদোন্নতি হয়েছে। এক্ষেত্রে আমার কিছু করার নেই। তবে তিনি টিকেট কালোবাজারীর বিষয়টি অস্বীকার করেন তিনি।

ট্যাগ :

আরো সংবাদ

ফেইসবুকে আমরা



আর্কাইভ
December 2024
M T W T F S S
 12
3456789
10111213141516
17181920212223
24252627282930
আলোচিত খবর

error: কি ব্যাপার মামা !!