খোদা শোক সইবার শক্তি আমায় দাওঃ-(কবির হোসেন সিদ্দিকী)


সিএইচটি টাইমস অনলাইন প্রকাশের সময় :২৩ ডিসেম্বর, ২০১৭ ৩:২০ : পূর্বাহ্ণ 780 Views

চট্রগ্রামের বহুল পঠিত সংবাদপত্র দৈনিক সাঙ্গু ও দৈনিক প্রিয় চট্রগ্রাম পত্রিকার সম্পাদক সাংবাদিক কবীর হোসেন সিদ্দিকী তাঁর পরলোকগত পিতা-মাতা কে স্বরন করে তাঁর ফেসবুক আইডি তে একটি হ্নদয় স্পর্শী এস্টেটাস পোষ্ট করেছেন।সিএইচটি টাইমস ডটকম নিউজ পোর্টাল এর পাঠকদের জন্য তা হুবুহু তুলে ধরা হলোঃ-

আমি এখন পুরো এতিম আমার মা শামসুর নাহার মার গেছেন আজ থেকে ৯ বছর আগে।বাবা ছিদ্দিকুর রহমান মারা যান চলতি বছরের ২২ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায়।বাবা-মা হারানোর যন্ত্রণা আমার বুকে তুষের আগুনের মতো জ্বলছে।আমার বাবা আর মাকে কররস্থানে পাশাপাশি নিজ হাতে শুয়ে রেখে এসেছি আমি।চির সংগ্রামী পিতা-মাতা আমার।৫ ছেলে মেয়েকে মানুষ করতে সারাটা জীবন নিজেদের সুখ বির্সজন দিয়ে গেছেন।আজ ২৩ ডিসেম্বর।আজকের এই দিনে ২০০৯ সালের সকাল সোয়া ১০টায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যু বরণ করেন (ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাহে রাজেউন) আমার মা শামসুর নাহার।পিতা-মাতার যোগ্য সন্তান আমি হতে পারিনি।বাবা-মায়ের ঋণ শোধবার চেষ্টা করেছি, পারিনি।আমার মাকে হয়ত স্মরণ করে পৃথিবীর কোথাও আজ স্মরণ সভা হবে না।আমার মায়ের কবরে হয়তো আজ কেউ ফুল দিতে যাবে না।মা মারা যায়ওর ৯ বছর অতিক্রান্ত হলেও কারো হয়ত কিছুই আসে যাবে না।কিন্তু আমি আমার মাকে একটি মিনিটের জন্যও ভুলতে পারি নি।একজন মা তার সন্তানের জন্য কতটুকু করতে পারে তা নিয়ে আমি অনেক বার লিখেছি।কিন্তু মায়ের দু:খের কাহিনী আমি আজীবন লিখেও শেষ করতে পারবো না।বাবা একটা সময় একেবারে বেকার ছিলেন। সংসারের দায়ভার ছিল মায়ের উপর ৫ সন্তানকে দু’বেলা খাওয়াতে এক সময় বেছে নেন অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ।সারাদিন পরিশ্রম করে যা পেতেন তা দিয়েও হতো না আমাদের।বাসায় ফেরার সময় মা আশে পাশ থেকে কচুর লতি আর শাক নিয়ে আসতেন আমরা একবেলা ভাত আর আরেক বেলা কচু শাক খেয়ে জীবনের অনেকটা সময় পার করেছি।এ নিয়ে আমাদের কোন আপসোষ নেই।ছিল নাও।আমি তখন ক্লাস এইটের ছাত্র বান্দরবান সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ি।অভাব অনটনের মধ্যে স্কুলের সাদা জুতো আর একটা সাদা শার্ট কেনা খুব কষ্টসাধ্য ব্যাপার ছিল।তা ছাড়া আমার ছোট ভাই ফারুক ছিলাম একই ক্লাসে।আমাদের ক্লাস টিচার ছিলেন বাবুল দাশ।সাদা জুতা আর শার্ট পরে না যাওয়ার কারণে তার হাতে প্রতিদিন মার খেতে হতো আমাদের।মারের যন্ত্রণায় আমি আর ফারুক এক সময়ে ক্লাস ফাঁকি দিতে শুরু করি।মা যখন বিষয়টি জানলেন আমার বাল্যকালের বন্ধু জয়নালের কাছ থেকে একটা সাদা পুরোনো শার্ট আমাকে খুজে এনে দিয়েছিলেন।সেই পুরোনো শার্ট পরে ৬ মাস আমি স্কুলে গিয়েছি।সেই পুরোনো সাদা শার্ট ২৫ বছর ধরে আমি এখনো স্মৃৃতি হিসেবে রেখে দিয়েছি।আজ এই লেখার মাধ্যমে আমি জয়নাল আবেদীনকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।আমার খুব কাছের এক বন্ধুর খালার বিয়ে।আমার ব্যাচে ছিলাম ৫ জন।সবাইকে বিয়ের দাওয়াত দিয়েছিল।কিন্তু আমি বাদ পড়েছিলাম।কারণ ছিল আমার একটা ভালো জামা ছিল না।খারাপ জামা পরে তাদের বিয়েতে গেলে তাদের সম্মানের ক্ষতি হতো।ধন্যবাদ বন্ধু তোকেও সেই দিনের স্মৃৃতি মনে রেখে আমি অনেকে জামা কিনে দিয়েছি।সে দিনের ঘটনায় মা অঝোর ধারায় কেঁদেছিল।পরে মা বাজার থেকে একটি নতুন শার্ট আমাকে কিনে দিয়েছিল।আমার মা।আমার চির দু:খী মা।মা পৃথিবীর কেউ তোমাকে মনে না রাখুক আমি প্রতিটা দিন শুরু করি তোমার কবর জেয়ারত করে।মাগো, তোমার তোমার সেই ফকিন্নির ছেলেকে এখন অনেকে চেনে অনেকে সম্মান করে।মা জানো তোমার মতো কোন দু:খিনী মা আমার নজরে এলেই তুমি মনে করে আমি তাকে জড়িয়ে ধরি।মৃত্যুর আগের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত জীবনের সাথে সংগ্রাম করে গেছেন আমার মা।আমি যখন অভাবে ছিলাম তখন মা ছিল আজ আমি প্রতিষ্ঠিত মা নেই।আমাদের মুখে এক মুঠো ভাত তুলে দিতে আমার মা অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন।রাত-দিনের পরিশ্রম আমার মাকে খুড়ে খুড়ে খেয়েছে আমারা বুঝতে পারিনি। অবশেষে যখন বুঝতে পারলাম মাকে বাঁচানোর মত অর্থকড়ি আমার হাতে ছিল না।চট্টগ্রামের মেডিক্যালে এক প্রকার বিনা চিকিৎসায় আমার মা মৃত্যু বরণ করেন। মায়ের অতৃপ্ত আত্মার কান্নার শব্দ আমি আজো শুনতে পাই।৯ বছরের প্রতিটি দিন আমাকে আমি স্মরণ করেছি।অভাব কি জিনিস আমার চেয়ে কেউ হয়তো বেশি দেখেনি।আমার বয়স তখন হয়তো ১২-১৩ বছর।আমি তখন থেকেই দেখেছি সংসারের অভাব।সেই সময় থেকেই আমরা একবেলা খেয়ে না খেয়ে বড় হয়েছি।একদিন রাতের বেলায় মা আমাদের ৫ ভাইবোনকে খাবার দিলেন আমরা পেট পুরে খেয়ে উঠলাম।মাকে প্রশ্ন করলাম খাবে না,মা বললো পরে খাবো।আমার মন মানছিলো না।সবাই চলে যাওয়ার পর পাত্রে দেখলাম খাবার নেই।কাঁদলাম।শপথ নিলাম বড় হলে মাকে বেশি করে খাওয়াবো।দুুই দিন বাদে আমার আর ছোট ভাইয়ের ৮ম শ্রেণির বাষিক পরীক্ষা।ফি দেওয়া হয়নি।ক্লাসে গেলাম,স্যার বললো আজ ফি জমা না দিলে তোমরা পরীক্ষা দিতে পারবেনা।দৌড়ে বাসায় ফিরলাম। দেখি বাসায় খাবারও নেই।কি করে মাকে বলি পরীক্ষা ফি’র কথা তারপরও বললাম।মায়ের দুচোখ দিয়ে পানি ঝরলো।তার পর তিনি পাশের বাড়ির মহিলার কাছে তারা কানের দুল বিক্রি করে এলেন ৩০০ টাকায়।আমার হাতে তুলে দিলেন সব টাকা।কান্না পেলো অনেক।মাকে তা বুঝতে দেইনি। মনে মনে শপথ নিলাম বড় হয়ে মায়ের অভাব দূর করবো।বাবা চড়ুই পাড়ায় দোলনা নিয়ে গেছেন। ২ দিন ধরে বাসায় রান্না হয়নি।আমি আমার ছোটভাই মেঝবোন দৌড়ে দৌড়ে স্কুল থেকে বাসায় ফিরলাম, বাবা বাজার নিয়ে আসবে আমরা আজ পেট ভরে খাবো।বাসায় এসে দেখি বাবা খালি হাতে ফিরেছেন।ছডুই পাড়ায় দোলনা নিয়ে যাবার সময় মা যে ৫০০টাকা ধার করে দিয়েছেন তাও লস করে এসেছেন।আজও ভাত রান্না হয়নি।মা আমাদের জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন।মনে মনে শপথ নিলাম বড় হয়ে মায়ের সব দু:খ মুছে ফেলবো আমি।দাদি মারা যাবেন রাতেই।গত দুদিন বাসায় রান্না হয়নি।বাবা লামায় চাকরিতে।রাত ১২টার দিকে দাদির শেষ অবস্থায় তিনি আম্মুকে বললেন, মা খুব খিদে পেয়েছে আমাকে একটু খাবার দাও। মা তাকে বললেন আজ রান্না হয়নি মা।দাদি বললেন ঠিক আছে কাল খাবো।কিছুক্ষণ পরেই না খেয়েই মারা গেলেন দাদি।মা সেই দৃশ্য মনে করে সারাটা জীবন কেঁদেছেন।মায়ের কান্না দেখে শপথ নিলাম মায়ের সব অভাব আমি দূর করবো।রাতে রান্না করার জন্য পাশের বাড়িতে দু পট চাউলের জন্য গেছে মা।আমি পড়তে বসেছি।খালি হাতে ফিরে মা বললো চাউলতো দেয়নি।আগের আনা চাউল দিতে পারিনি বলে তারা আমাকে অপমানিত করেছে।মাকে জড়িয়ে ধরে আমিও কাঁদলাম।শপথ নিলাম এই অভাব আমিই গোছাবো।আজ আমার সংসারে অভাব নেই।আমার করা শপথ আমি রেখেছি।দারিদ্র্যতাকে আমি জয় করেছি।তবে যার জন্য আমার এই জয় সেই মা-ইতো নেই।তিনি জীবনে পরাজিত হয়ে চলে গেছেন পরপারে।মায়ের সেই অতিত স্মৃৃতি মনে করে এখনো আমি কাঁদি,নিজের অজান্তে কাঁদি।গভীর রাতে কেঁদে উঠি মাকে বলি ফিরে এসো মা।দেখো তোমার ছেলে গাড়িতে চড়ছে।তোমার ছেলেকে অনেকে স্যার ডাকছে।মাতো ফিরে না।মাকে বলি আমায় ক্ষমা করো,মা আমি তোমাকে সুখী করতে পারলাম না।তোমার মৃত্যুর পরই এলো আমার সব স্বচ্ছলতা।ক্ষমা করো মা ক্ষমা করো আমাকে।মায়ের ৯ বছর পর বাবাও চলে গেলেন পরপারে।আমার বাবার হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রম ছিল আমার পেছনে আমার বাবা একজন পানিওয়ালা।পানি ফেরি করে তিনি আমাদের মানুষ করেছেন।অনেকে এখনো আমাকে পানিওয়ালার ছেলে বলে ঠাট্টা করে।আমি মজা পাই,গর্ববোধ করি।আমি পানিওয়ালার (পানি বিক্রেতা) ছেলে।বাজারে সারাদিন পানি ফেরি করে বাবা যা আয় করতেন তা দিয়ে আমাদের কোন রকম সংসার চলতো।পরিশ্রমি মানুষটি সারা জীবনই জ্বলেছেন।তিনিও সুখের সময়ে চলে গেলেন।কোন কষ্ট ছাড়াই আমার সাথে কথা বলার ৫ মিনিটের মধ্যেই।আমি নামাজে ছিলাম তখন।
ঢাকা যাবো।তাড়াতাড়ি অফিসের কাজ শেষ করে বাসায় গেলাম।তখন সময় ৮টার একটু বেশি।বাবা তার তিনটা ব্যাগ রেডি করে আমার সামনে আসলেন।দরজার সামনে সেন্ডেল রাখলেন বাসার নিচে যাওয়ার জন্য।আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম কই যাবেন।বললেন নিচে যাবো কন্টিন ট্যাবলেট আনতে।তাকে তিনটা ১০ টাকার নোট আর একটা ২ টাকার নোট দিলাম। বললাম গুনেন।তিনি গুনে বললেন ৩২ টাকা।হাসলাম।পরে বাবা আমার অফিসের (অফিস সহকারী) মিসকাতকে ১০ টাকা দিয়ে বললেন ২টা কন্টিন আনতে।আমি বাবাকে বললাম আপনিতো এর চেয়ে ভালো ওষুধ খাচ্ছেন। কন্টিন লাগবে না বাবা।এই বলে আমি আর কামরুল ভাই এশার নামাজে দাঁড়ালাম।নামাজ থেকে শুনছিলাম বাবা বেসিনে বমি করছেন।ফরজ নামাজ শেষ করে তাড়াতাড়ি বাবার পাশে আসলাম। বমি করেই বাবা আমার কোলে ঢলে পড়লেন। ৫ মিনিটেই বাবা আমাকে ছেড়ে চলে গেলেন।একজন পানিওয়াল মৃত্যুতে এই দেশের এই সমাজের কোন ক্ষতি হয়তো হয়নি।ইতিহাসেও তাঁর নামও সোনার অক্ষরে লিখা থাকবে না।কিন্তু আমার জীবনের ইতিহাসে তিনি অমর।বাবার বয়স যখন ১ বছর,তিনি তার বাবা আলী আহাম্মেদকে হারান।দাদি অন্যত্র বিয়ে করেন।সে এক বছর বয়স থেকে তিনি জীবন যুদ্ধ শুরু করেন।সমাজের মানুষের চরম অবহেলা,লাঞ্ছনা নিয়ে বেড়ে উঠেন তিনি।জীবনে কত শত দিন তিনি উপোস করেছেন সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আর কেউ জানে না।কখনো অন্যের জমিতে চাষাবাদ,কখনো চা ফেরি কখনো দৈনিক মজুরীর কাজ করেছেন তিনি। সমাজের মানুষের চরম অবহেলায়ও তিনি দমে জাননি।বাবা লেখাপড়াও করতে পারেননি।কোন দিন তাঁর স্কুলে যাওয়ার সুযোগ হয়নি।এক পর্যায়ে মা ছায়েরা খাতুন (আমার নানী) পাগল হয়ে যান। অন্য ছেলেরা তাকে ফেলে চলে গেলেও বাবা তাকে নিয়ে সাতকানিয়া থেকে যুবক বয়সে বান্দরবানে পাড়ি জমান।শুরু হয় তার জীবনের চরম যুদ্ধ।
বান্দরবানে এসে এক সপ্তাহ না খেয়ে ছিলেন বাবা। তৎকালীন সময়ে বান্দরবানের নদী পাড়ে বলি খেলা হতো।সাত দিনের উপোস বাবা অংশ নেন বলি খেলায়।আছাড় খেয়ে পড়ে যান তিনি।শান্তনা পুরষ্কার হিসেবে তাকে কিছু টাকা দেওয়া হয়।সে টাকায় বাবা আর তার পাগল মা আহার করেন।এভাবে জীবন চালিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি।বান্দরবানে এসে তিনি পানি ফেরির কাজে জড়িয়ে পড়েন।নদী-পুকুর থেকে পানি সংগ্রহ করে মানুষের বাসায়-দোকানে অফিসে পানি ফেরী করতেন তিনি। পরে মায়ের সাথে তার পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়। একে একে জন্ম নেয় ৫ সন্তান।সন্তানদের মানুষ করতে তিনি শুরু করেন নতুন যুদ্ধ।তিনি পুলিশ বিভাগে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে যোগ দেন।চাকরির প্রয়োজনে তাকে যেত হয়েছে অনেক দূর দূরান্তে।বেতনের সামান্য টাকায় চলতো না সংসার।শুরু হয় অভাব।আমরা ৫ ভাইবোন বড় হতে থাকি।খরচের বোঝা বাড়তে থাকে।এর মধ্যে ঘটে যায় জীবনের সবচেয়ে করুন ঘটনা।বাবা লামায় চাকরিতে ছিলেন।আমরা দু’ভাই ৫ শ্রেণিতে পরীক্ষা দিবো।খাতা কলম বই কিনতে হিমসিমে পড়ে যান বাবা।চরম অভাব নেমে আসে সংসারে।দুর্বল মানুষ হওয়ায় বাজার ফান্ডের তৎকালীন এক কর্মচারীর সহযোগিতায় এবং মেম্বার পাড়ার আনোয়ার নামে একজনের প্ররোচনায় আমাদের বসত বাড়ির একাংশ কেড়ে নেয় জহির নামে সরকারি এক কর্মচারী।বাবা তার বিরুদ্ধে মামলা করেন।পরিবার চালানো আর মামলার খরচ যোগাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন বাবা মা দু’জনই।আমি দেখেছি বাবার লামার চিইরতলী পুলিশ ক্যাম্পে ১২০ সিঁড়ি বেয়ে পানি তুলতেন।আমি দেখেছি বাবা বেতনের সকল টাকা খরচ না করে বাসায় পাঠিয়ে দিতেন।আমি দেখেছি বাবা তার থালার খাবার আমাদের খাইয়ে দিতে।জীবনের করুন ইতিহাস যেন আমাদের ছাড়ার নয়,আমার দু’বোন খুব সুন্দরী ছিলেন।গরীবের মেয়ে বলে নানাজনের নানা কথা বলার ভয়ে বড় বোনকে বিয়ে দিতে হয়েছে একজন ড্রাইভারের সাথে, আর ছোট বোনকে একজন তরকারী ব্যাপারীর সাথে।তৎকালীলন উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুল কুদ্দুছ দু’বোনের বিয়েতে উজাড় করে খরচ করেছিলেন। দুঃখে যার জীবন গড়া সুখ কি করে আসবে তার কাছে। আমি তখন সাংবাদিকতা শুরু করছিলাম মাত্র।মাকে পেয়ে বসে দুরারোগ্য ক্যান্সার।বড় বোনের জামাই-এর সহযোগিতায় তাকে ডুলাহাজারা খ্রিস্টান হাসপাতালে অপারেশন করা হয়।অপারেশনের পর বলা হয় মাকে চট্টগ্রাম নিয়ে থেরাপি দিতে।যাদের নুন আনতে পান্থা পুরায় তাদের আবার থেরাপি।অভাব যখন আমাদের নিত্য সঙ্গী মাকে তখন থেরাপী দেওয়া সম্ভব হলো না।এর পরে মায়ে শরীরে বাসা বাধে ডায়বেটিকস, হাঁপানীসহ নানারোগ।এক প্রকার বিনা চিকিৎসায় মা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান।মাকে হারানোর পর বাবা হয়ে যান আরো একা।মা মারা যাওয়ার পর আমি প্রতিষ্ঠিত হতে থাকি।চলে যাই চট্টগ্রামে।বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্যশৈহ্লার সহযোগিতায় আমি অনেক দূর এগিয়ে যাই।এগিয়ে আসে চট্টগ্রামের এস আলম গ্রুপও।এদিকে বাবার পরিশ্রমের শরীরে বাসা বাঁধে লাঞ্চ ক্যান্সার,হাঁপানী বাবাকে আমি চট্টগ্রামে নিয়ে আসি।দেশের সকল নামকরা ডাক্তার দিয়ে তাঁকে চিকিৎসা করায়।কিন্তু বিধাতা তার লিখনতো পাল্টায়না।আমাকে এতিম করে ২১ সেপ্টেম্বর বাবা চলে যান পরপারে।আমার বাবা কারো সাথে কখনো ঝগড়া করেছে,কারো সাথে কোন মনমালিন্য হয়েছে আমি দেখিনি।বাবা মারা যাওয়ার পর পার্শ্ববর্তী হিন্দুরাও তার জন্য অঝোরে কেঁদেছেন।তার জানাজা ইতিহাসের পাতায় স্থান না পেলেও অনেক মানুষের উপস্থিতি ছিল।বান্দরবানের হলি ডে ইনের ঘটনা।আমি তখন দৈনিক সাঙ্গুর সদ্য সম্পাদক হয়েছি।একটা অনুষ্ঠানে যোগদান করতে চট্টগ্রাম থেকে বান্দরবানে এসেছিলাম।ঢাকার এক মেহমানের সাথে পরিচয় হতে গিয়ে আমি তাকে বলেছিলাম আমি দৈনিক সাঙ্গুর সম্পাদক।পাশে আমার এক বন্ধু চিৎকার করে বলেছিলেন সম্পাদক না পানিওয়ালার ছেলে বল।সত্যিই আমি সেদিন অসংখ্য মানুষের সামনেই চিৎকার করে বলেছিলাম আমি পানিওয়ালার ছিদ্দিক্কার ছেলে।আমার বাবা পানিওয়ালা ছিলেন। আমার বাবা পরিশ্রম করে আয়-রোজগার করেছেন।আমার বাবা রক্ত ঘাম জড়িয়ে টাকা আয় করেছেন।আমার বাবার টাকা ছিল সৎ রোজগারের টাকা।সারাজীবনে এক টাকাও অসৎভাবে রোজগার করেননি বাবা।তাঁর রক্তে ঘামে কামানো টাকা খেয়েই আমি আজ কবির হোসেন সিদ্দিকী। আজও সমাজের সামনে সবার সামনে আমি গর্ব করে বলি আমি পানিওয়ালার ছেলে।কে কি বললো বা কি ভাবছে তাতে আমার কিছুই আসে যায়না।আমার চির দু:খি বাবার জন্য সকলের কাছে দোয়া ভিক্ষা করছি।বান্দরবানের কেন্দ্রীয় কবরাস্থানে মায়ের পাশে শুয়ে আছেন বাবা।

লেখক:-সম্পাদক,দৈনিক সাঙ্গু,দৈনিক প্রিয় চট্টগ্রাম।

 

ট্যাগ :

আরো সংবাদ

ফেইসবুকে আমরা



আর্কাইভ
December 2024
M T W T F S S
 12
3456789
10111213141516
17181920212223
24252627282930
আলোচিত খবর

error: কি ব্যাপার মামা !!