ব্যাংকগুলোকে কড়া হুঁশিয়ারি


অনলাইন ডেস্ক প্রকাশের সময় :১৭ আগস্ট, ২০২২ ১:৫৪ : অপরাহ্ণ 271 Views

কিছু দিন ধরেই ডলার নিয়ে কারসাজি চলছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বিষয়টি আঁচ করতে পেরে অভিযান পরিচালনা করে। এতে কয়েকটি ব্যাংক ও বেশ কিছু মানি চেঞ্জারের বিরুদ্ধে কারসাজির প্রমাণ মেলে। ছয়টি ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধানদের প্রত্যাহার এবং দায়ী মানি চেঞ্জারদের লাইসেন্স বাতিলসহ অন্তত ৪৫টিকে শোকজ করা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় গত রবিবার শীর্ষ ব্যাংকার ও বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনে জড়িত ব্যাংকের সংগঠন বাফেডা সদস্যদের নিয়ে বৈঠকে বসে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, ব্যাংকগুলো ডলার বাজার থেকে যে অস্বাভাবিক মুনাফা করেছে, তা ব্যাংকের আয়ে নিতে পারবে না। এখন আমদানিতে কম দাম নিয়ে তা সমন্বয় করতে হবে। ডলারের বাজার কঠোরভাবে তদারকি অব্যাহত রাখা হবে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে জানানো হয়। একই সঙ্গে ডলারের বাজার নিয়ন্ত্রণে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ডলার কেনাবেচায় দামের ব্যবধান (স্প্রেড) সর্বোচ্চ কত হতে পারবে, তা বেঁধে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যে দরে ডলার কেনা হবে, বিক্রির দাম হবে তার চেয়ে সর্বোচ্চ ১ টাকা বেশি।

জানা গেছে, গত তিন মাস ধরেই আমদানির চাপে দেশে মার্কিন ডলারের তীব্র সঙ্কট। বেড়েছে দাম, অন্যদিকে কমছে টাকার মান। খোলাবাজার বা কার্ব মার্কেটে নগদ ডলার ১২০ টাকা পর্যন্ত ওঠে। এখন আন্তঃ ব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলারে কিনতে খরচ করতে হচ্ছে ৯৫ টাকা। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারী আমদানি বিল মেটাতে এই দরে ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করছে। নিয়ম অনুযায়ী এটাই ডলারের আনুষ্ঠানিক দর।

চলতি বছরের মে মাসের শুরুর দিকে এ দর ছিল ৮৬ টাকা ৪৫ পয়সায়। এ হিসাবে দেড় মাসের ব্যবধানে টাকার মান কমেছে ৮ টাকা ৫৫ পয়সা। তবে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতেও এখন ১০৬ থেকে ১০৮ টাকায় নগদ ডলার বিক্র হচ্ছে। এদিকে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ডলার সংরক্ষণ করে দাম বায়েবিক্র করার প্রমাণ পাওয়ায় গত ৮ আগস্ট দেশী-বিদেশী ৬টি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধানকে অপসারণ করতে নির্দেশ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংকগুলো হলো-  বেসরকারী খাতের ব্র্যাক ব্যাংক, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক, সিব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক ও সাউথইস্ট ব্যাংক এবং বিদেশী খাতের স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক।

জানা গেছে, এসব ব্যাংক ডলার বিক্রি করে ৪৫০ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফা করেছে। এই বাস্তবতায় বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার এ্যাসোসিয়েশন-বাফেডা ও এ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ– এবিবির সদস্যদের নিয়ে বৈঠক করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অনুষ্ঠিত সভায় সভাপতিত্ব করেন গবর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার।

সভায় বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়া হয়, ব্যাংকগুলো ডলার বাজার থেকে যে অস্বাভাবিক মুনাফা করেছে, তা ব্যাংকের আয়ে নিতে পারবে না। এখন আমদানিতে কম দাম নিয়ে তা সমন্বয় করতে হবে। ডলারের বাজার কঠোরভাবে তদারকি অব্যাহত রাখা হবে। সভায় বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে ব্যাংকগুলোর কাছে পরিস্থিতি জানতে চাওয়া হয়। ব্যাংকগুলো বেশি দামে প্রবাসী আয় আনার বিষয়টি তুলে ধরে। এ জন্য ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যস্থতায় প্রবাসী আয় আনার উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানায়।

তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই প্রস্তাব নাকচ করে দেয়। সভায় বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, রফতানি ও প্রবাসী আয় দিয়ে আমদানি দায় শোধ করা যাচ্ছে না। এতে যে ঘাটতি হয়েছে, সেই পরিমাণ ডলার বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে বিক্রি করা হয়েছে। এর পরও কেন এত সঙ্কট হবে। এই সুযোগে ব্যাংকগুলো দাম বাড়িয়ে অস্বাভাবিক মুনাফা করেছে।

সভায় ব্যাংকগুলোকে বুঝে-শুনে আমদানি ঋণপত্র খুলতে বলা হয়। আর জানানো হয়, আমদানি ঋণপত্র খোলা কমেছে। প্রবাসী আয়ও বাড়ছে। ফলে সঙ্কট কেটে যাবে। যে রফতানি হচ্ছে, তার আয় দ্রুত সময়ে এনে নগদায়ন করতে বলা হয়। সভা শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ডলারের বাজারে যে টানাপোড়েন চলছে, তা থামাতে পরামর্শমূলক সভা ডাকা হয়েছিল। ব্যাংকগুলো যাতে রফতানি বিল দ্রুত দেশে আনে ও নগদায়ন করে, এ জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

পাশাপাশি ব্যাংকগুলোর মধ্যে ডলার কেনাবেচা শুরু করতে বলা হয়েছে। এটা হলে এক-দুই মাসের মধ্যে ডলারের বাজার স্বাভাবিক হয়ে আসবে। সিরাজুল ইসলাম আরও বলেন, আমদানি ঋণপত্রে সমন্বয়ে প্রতি ডলারে যত কম মুনাফা করা যায়, তা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। আমদানি ঋণপত্র খোলা কমেছে, ব্যাংকগুলোকে বুঝে ঋণপত্র খুলতে বলা হয়েছে।

ব্যাংকগুলো বলছে, কেনা ও বিক্রিতে সর্বোচ্চ পার্থক্য হবে এক টাকা। এর ফলে প্রবাসী আয়ে প্রতি ডলার ১১০ টাকা ও রফতানি বিল নগদায়নে ১০৫ টাকা হলে আমদানিতে ডলারের দাম হবে সর্বোচ্চ ১০৮ টাকা ৫০ পয়সা। ডলারে স্প্রেড সর্বোচ্চ এক টাকা হবে, এটা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেশ আগের সিদ্ধান্ত। বর্তমান সঙ্কটের কারণে যা কার্যকর নেই। এখন পুরনো সিদ্ধান্ত আবারও কার্যকর করে সঙ্কট সমাধানের পথ দেখাচ্ছে ব্যাংকগুলো।

এদিকে গত রবিবার খোলাবাজারে বেশ কিছুটা উত্তাপ হারিয়েছে আমেরিকান এই মুদ্রা। গত সপ্তাহের শেষ কর্মদিবসের তুলনায় চার টাকারও বেশি দর হারিয়েছে ডলার। সপ্তাহের প্রথম দিন প্রতি ডলারের জন্য ১১৪ টাকা ৫০ পয়সা নিয়েছেন ব্যবসায়ীরা; কিনেছেন ১১৪ টাকায়। তবে ব্যাংকগুলো আগের দামেই নগদ ডলার বিক্রি করছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘গত সপ্তাহে দর ১২০ টাকায় ওঠার পর সরকারের বিভিন্ন সংস্থার তৎপরতা বেড়ে যায়। সে কারণে ভয়ে কেউ ডলার কিনছেও না; বিক্রি করছে না। কিছু লেনদেন হচ্ছে খুবই গোপনে।’ বাজারে ডলারের সরবরাহ বেড়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সেটা একটু বেড়েছে বলে মনে হচ্ছে, সে কারণেই দামটা নিম্নমুখী।’

রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক গত রবিবার ১০৪ টাকা দরে নগদ ডলার বিক্রি করেছে। জনতা ব্যাংক থেকে কিনতে লেগেছে ১০৪ টাকা ২৫ পয়সা। বেসরকারী সিটি ব্যাংক প্রতি ডলারের জন্য নিয়েছে ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা। ইস্টার্ন ব্যাংক বিক্রি করেছে ১০৭ টাকায়। এসআইবিএল নিয়েছে ১০৫ টাকা। গত সপ্তাহের মতো ৯৫ টাকায় রবিবার ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এটাকে আন্তঃব্যাংক বা ইন্টারব্যাংক রেট বলছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে এই রেট গত দুই মাসের বেশি সময় ধরে কার্যত অচল। ব্যাংকগুলো এখনও এই দরের চেয়ে ৯ থেকে ১৫ টাকা বেশি দামে ডলার বিক্রি করছে। আবার প্রবাসী আয় বা রেমিটেন্স সংগ্রহ করছে ১০৪-১০৫ টাকা দিয়ে। আমদানি ঋণপত্র খুলতে নিচ্ছে ১০৪-১০৫ টাকা।

পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটে চলা ডলারের দৌড় থামাতে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে চলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের ১ মাস ১১ দিনে (১ জুলাই থেকে ১১ আগস্ট) ১৭২ কোটি ৫৪ লাখ (১.৭২ বিলিয়ন) ডলার বিক্রি করা হয়েছে। এর পরেও বাজারে ডলারের সঙ্কট কাটছে না।

খোলাবাজারের ব্যবসায়ীরা জানান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদারকির কারণে অনেক ব্যবসায়ী ডলার কেনাবেচা করতে ভয় পাচ্ছেন। খোলাবাজারে ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে এর আগেও রাজধানীর বিভিন্ন মানি চেঞ্জারে অভিযান চালায় বাংলাদেশ ব্যাংক। জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে এ পরিদর্শন কার্যক্রম চালাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

পাশাপাশি অবৈধভাবে ডলার মজুদকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার ঘোষণা দিয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। ডলার কারসাজিতে জড়িত থাকার অভিযোগে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশে ছয় ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধানকে অপসারণ করা হয়েছে। তবে এর পরও বাজার স্বাভাবিক হচ্ছে না।

ট্যাগ :

আরো সংবাদ

ফেইসবুকে আমরা



আর্কাইভ
December 2024
M T W T F S S
 12
3456789
10111213141516
17181920212223
24252627282930
আলোচিত খবর

error: কি ব্যাপার মামা !!