গোয়েন্দা প্রতিবেদন: ফেঁসেই যাচ্ছেন বৌদ্ধ ভিক্ষু শরণাংক থের


অনলাইন ডেস্ক প্রকাশের সময় :২৩ অক্টোবর, ২০২০ ১০:৪০ : অপরাহ্ণ 378 Views

বৌদ্ধ ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে দখল করে নিয়েছেন বনবিভাগের ৫০ একর জায়গা। স্থাপনা নির্মাণের নামে উপড়ে ফেলেছেন হাজার হাজার গাছ। মেতেছেন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের নতুন খেলায়। এমনই অভিযোগ চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার ফলাহারিয়া গ্রামের বৌদ্ধ ভিক্ষু শরণাংক থেরের বিরুদ্ধে। শুধু তাই নয়, অন্য ধর্ম ও বিশিষ্টজনদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিনিয়ত উসকানিমূলক ভিডিওবার্তা ও বক্তব্য দেয়ারও অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। অনুসন্ধানে নেমে এর সত্যতাও পেয়েছে সরকারের একটি প্রভাবশালী গোয়েন্দা সংস্থা।

গতকাল (২২ অক্টোবর) বৃস্পতিবার সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে তার বিষয়ে গোয়েন্দা প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে। তাতে এই বৌদ্ধ ভিক্ষুর বিরুদ্ধে দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। শরণাংক থেরকে রাঙ্গুনিয়ার পদুয়া ছাড়তে হবে না হয় তার বিরুদ্ধে করা মামলায় যে কোনও সময়ে গ্রেপ্তার হবেন বির্তিকিত এ ভিক্ষু। এমনটিই জানিয়েছে গোয়ন্দা সূত্র।

শরণাংক থেরের কারণে এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করছে। তাকে গ্রেপ্তারের দাবি এসেছে হিন্দু মুসলমান ও বৌদ্ধদের সব পক্ষ থেকেই।

সরকারের প্রভাবশালী একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে শরণাংক থের পরিচয় সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘বৌদ্ধ ভিক্ষু শরণাংক থের ১৯৮৪ সালের ১৬ আগস্ট চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী উপজেলার মধ্যম মাদার্শা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম দিলীপ বড়ুয়া এবং মাতার নাম ডেজি বড়ুয়া। ২০০৪ সালের ২৪ অক্টোবর তিনি সন্ন্যাসী জীবন গ্রহণ করেন। ২০১১ সালে তিনি রাঙ্গুনিয়া উপজেলার ফলাহারীয়া এলাকায় স্থানীয় বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের সহায়তায় বন বিভাগের শূণ্য দশমিক ৫ একর জায়গায় ঘর করে ধ্যান শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি পর্যায়ক্রমে বন বিভাগের প্রায় ৫০ একর জায়গা দখল করে গড়ে তুলেছেন জ্ঞানশরণ মহারন্য বৌদ্ধ বিহার। বৌদ্ধ বিহারটিতে বিভিন্ন প্রকার ৮ টি মূর্তি রাখার জন্য পাকা ঘর ২ টি, কাঁচা ঘর ১০ টি, জ্ঞান ঘর ১টি, নির্মাণাধীন বিল্ডিং ৩ টি, টয়লেট ৫ টি, খননকৃত পুকুর ১ টি, টিউবওয়েল ৪টি ও নির্মাণাধীন তোরণ ১টি। বিহারটিতে ভিক্ষুক সহ শতাধিক লোক বসবাস করেন।’

সরকারের প্রভাবশালী ওই গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বৌদ্ধ বিহারটিতে কারা কারা যাতায়ত করতেন তারও একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হয়েছে সরকারের শীর্ষ মহলে। এতে বলা হয়, ‘বৌদ্ধ বিহারটিতে লায়ন আদর্শ ঝুমার বড়ুয়া ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা লায়ন আদর্শ ঝুমার বড়ুয়া, বাংলাদেশ বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘ (চট্টগ্রাম অঞ্চল) সহ-সভাপতি লায়ন মৃদুল চৌধুরী, বাংলাদেশ বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘের কেন্দ্রীয় কমিটির আইন সচিব বাবু প্রদীপ বড়ুয়া, রাঙ্গুনিয়ার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ বাবু দিলীপ বড়ুয়াসহ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীর গুরু ও নেতারা আগমন করেন। লোহাগাড়া উপজেলার আলোচিত-সমালোচিত কারাবন্দি রকি বড়ুয়ার সাথেও ভিক্ষুক শরণাংক থেরের সুসম্পর্ক রয়েছে। বনে আসা যাওয়া ছাড়াও বিহারটিতে বুদ্ধ পূর্ণিমা অনুষ্ঠানে দেশের বিভিন্ন স্থানের পাশাপাশি কোরিয়া, জাপান, থাইল্যান্ড ও বার্মার লোকজন আসতেন। তবে বৌদ্ধ বিহারটিতে মুসলিমদের প্রবেশে বাধা প্রদান করা হয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

বন বিভাগ ও বৌদ্ধ বিহারের মধ্যে চলমান বিবাদ সম্পর্কে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জ্ঞানশরণ বৌদ্ধ বিহারটির প্রতিষ্ঠাতা শরণাংক থের ২০১১ সালে রাঙ্গুনিয়া উপজেলার সুখবিলাস বন বিটের আওতাধীন খুরুশিয়া রেঞ্জের শূণ্য দশমিক ৫ শতক জায়গায় ঘর করে ধ্যান শুরু করেন।‌ পরবর্তীতে তিনি পর্যায়ক্রমে বন বিভাগের প্রায় ৫০ একর জায়গা দখল করে জ্ঞানশরণ মহারন্য বৌদ্ধ বিহারটি প্রতিষ্ঠা করেন। বন বিভাগ কর্তৃপক্ষ প্রথম পর্যায়ে উত্তেজনার ভয়ে জায়গা উদ্ধারের জন্য উল্লেখযোগ্য কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। কিন্তু গত ২২ অক্টোবর ২০১৯ তারিখে তারা নতুন করে জায়গা দখল করার চেষ্টা করলে বনবিভাগ কর্তৃপক্ষ তাতে বাধা প্রদান করায় বৌদ্ধ ভিক্ষু শরণাংক থের সহ অর্ধশতাধিক লোকজন বন কর্মীদের উপর হামলা করেন। এ ঘটনায় বন বিভাগ গত ৩০ অক্টোবর ২০১৯ তারিখ বৌদ্ধ ভিক্ষু শরণাংক থের সহ অজ্ঞাত নামা ৩৫/৪০ জনের বিরুদ্ধে রাঙ্গুনিয়া থানা মামলা দায়ের করে। সম্প্রতি গত ৬ জুন ২০২০ তারিখে দুর্বৃত্তরা রাতের আঁধারে বৌদ্ধ বিহারের পার্শ্ববর্তী বন বিভাগের ৭৫ হাজার গাছের চারা নষ্ট করে। উক্ত ঘটনায় বনবিভাগ কর্তৃপক্ষ বৌদ্ধ বিহার কর্তৃপক্ষকে দায়ী করে এবং গত ৯ জুন ২০২০ তারিখ অজ্ঞাত ৮/৯ জনের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করে। এ নিয়ে উভয়পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে।’ এসবও গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

শরণাংক থের শুধু বন বিভাগের সাথেই বিরোধে জড়ায়নি। তিনি স্থানীয় মুসলমানদের একটি মাজার কর্তৃপক্ষের সাথেও বিরোধে জড়িয়েছেন। ওই গোয়েন্দা প্রতিবেদনে তা উল্লেখ করে বলা হয়, ‘রাঙ্গুনিয়া উপজেলার পদুয়া ইউনিয়নের ফলাহারিয়া এলাকায় শাহসুফি হযরত পাঠান আউলিয়া (রহ.) এর ২০০/২৫০ বছর পুরনো একটি মাজার রয়েছে। মাজারকে কেন্দ্র করে ২০১৪ সালে স্থানীয় সংসদ সদস্য ড. হাছান মাহমুদের ছোট ভাই এরশাদ মাহমুদ ও স্থানীয়দের আর্থিক সহযোগিতায় মাওলানা মোহাম্মদ হাকিম উদ্দিন আল কাদেরী মাজার প্রাঙ্গণে একটি সুন্নিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানা প্রতিষ্ঠা করেন। উক্ত মাজারটি থেকে জ্ঞানশরণ মহারন্য বৌদ্ধ বিহারটির দূরত্ব প্রায় ২ কিলোমিটার। ফলাহারিয়া গ্রামের প্রধান সড়ক থেকে একই পথে মাজার অতিক্রম করে বৌদ্ধ বিহারে যেতে হয়। আনুমানিক ২ বছর পূর্বে বৌদ্ধবিহার কর্তৃপক্ষ প্রধান সড়ক থেকে মাজার ও বিহারের দিকে প্রবেশ পথে বৌদ্ধমূর্তি সম্বলিত গেট নির্মাণের চেষ্টা করলে মাজার কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় মুসলমানরা পবিত্রতা রক্ষার জন্য তাদের বাধা প্রদান করেন। এ নিয়ে বিহার কর্তৃপক্ষের সাথে তাদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ রয়েছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, অবৈধভাবে বন বিভাগের জমি দখল করে বৌদ্ধ বিহারের পরিধি বৃদ্ধি করছেন। পরবর্তীতে অবৈধভাবে দখল করা এসব জায়গা দেখিয়ে আশ্রমের কথা বলে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মাধ্যম থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন শরণংকর থের।

দীর্ঘদিনের মাঠ পর্যায়ের তদন্ত শেষে গত ২২ অক্টোবর প্রভাবশালী ওই গোয়েন্দা সংস্থা সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে বৌদ্ধ ভিক্ষু শরণাংক থেরের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করেছে। বর্তমানে বৌদ্ধ ভিক্ষু শরণাংক থেরের বিষয়টি নিয়ে এলাকাবাসীর মধ্যে চাপা ক্ষোভ রয়েছে এবং ওই ভিক্ষুক রাঙ্গুনিয়ার এলাকায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার চেষ্টা করছেন। তার বিরুদ্ধে রাঙ্গুনিয়ায় হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ সহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ এসব বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য প্রতিবাদ করছেন বলে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।র

রনি ড্রাইভার থেকে বৌদ্ধ ভিক্ষু

​​​রাঙ্গুনিয়ায় বনভূমির ৫০ একর ভূমি দখল করে বৌদ্ধবিহার স্থাপন, সনাতন সম্প্রদায়ের শ্মশান দখল এবং ইসলাম ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করে দেশজুড়ে বিতর্কিত শরণাংক থেরের অতীত কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রতিদিনিই আসছে নিত্যনতুন তথ্য। সেই ধারাবাহিকতায় এবার বেরিয়ে এসেছে রনি ড্রাইভার থেকে শরণাংক থের কিংবা গ্যারেজকর্মী থেকে তিনি কীভাবে বৌদ্ধভিক্ষু বনেছেন সেই গল্প।

জানা যায়, রনি বড়ুয়ার (শরণাংক থের) বয়স যখন ১০-১১, তখনই তার বাবা-মার বিচ্ছেদ ঘটে। বিচ্ছেদ-বিভাজনের সংসার থেকে কিশোর রনি বড়ুয়ার ঠাঁই হয় নগরের শুলকবহর পাঁচকড়ি বাবুর গ্যারেজে। সেখানে গ্যারেজকর্মী হিসেবে খাটতে খাটতে একসময় গাড়ি-চালনা রপ্ত করতে সক্ষম হন তিনি।

গাড়ি-চালনা রপ্ত করার পর রাউজান মুন্সিরহাটের এক গাড়ির মালিক তাকে নিয়ে এসে নিজের প্রাইভেট কার চালানোর দায়িত্ব দেন। রনি ড্রাইভারের ড্রাইভিং জীবন এখানে স্থায়ী ছিল বেশকিছুদিন।

এদিকে, ২০০৮ সালের দিকে রাঙ্গুনিয়া উপজেলার পদুয়ার জয়সেন বড়ুয়া নামক এক লোকের কাছে কারটি বিক্রি করে দেওয়া হলে রনি ড্রাইভার সেটি নিজেই চালিয়ে নিয়ে যান পদুয়ায়। সেই সুবাদে গাড়ির নতুন ড্রাইভার জসিমের (স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আপেল আহমেদের মেয়ের জামাই) সাথে পরিচয়, তারপর ধীরে ধীরে সখ্যতা গড়ে তোলেন রনি ড্রাইভার।

সেই সুবাদে জসিম ড্রাইভার তার অবর্তমানে রনিকে গাড়ির চাবি দিয়ে বেকার সময়টাতে কিছুটা সহযোগিতা করতেন। অর্থাৎ বদলি ড্রাইভার হিসেবে কিছুদিন পদুয়া থাকার সুযোগ হয় তার। এভাবে জসিমের করুণায় কিছুদিন পার করার পর বৌদ্ধ ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী শ্রমণ হতে চলে যান রনি বড়ুয়া।

শ্রমণের নির্দিষ্ট সময় পার হয়ে গেলে তিনি পুনরায় স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যান। ফিরেই ভাবনায় পড়ে যান ধুরন্ধর রনি-কী হবে জীবনের গতিপথ? কোনপথে গেলেই মিলবে মানিকরতন। জানেন শুধু ড্রাইভিং! সারাজীবন পরের গাড়ি চালিয়ে কী আর হবে? ভাগ্যের তো কোনো পরিবর্তন হবে না। তাই সিদ্ধান্ত নিলেন ভান্তে সাজবেন। আর সেটি হয়েই ভোগবিলাসহীন জীবনের আড়ালে মূলত বিলাসব্যসনের জীবনই তার লক্ষ্য।

আর দেরি করলেন না, গায়ে বৌদ্ধদের পবিত্র লালকাপড় জড়িয়ে আস্তানা গাড়েন শান্তির জনপদ রাঙ্গুনিয়ার ফলাহারিয়া গ্রামের সংরক্ষিত বনাঞ্চলে। রাতারাতি ‘রনি’ নাম পাল্টিয়ে শরণাংক থের নাম ধারণ করেন। স্থানীয়দের মতে, দ্বিতীয়বার পদুয়া ইউনিয়নের ফলাহারিয়া গ্রাম বেছে নেয়ার কারণ হয়তো পদুয়ার মানুষের আতিথেয়তা এবং অসাম্প্রদায়িক পরিবেশ।

স্থানীয়রা জানান, প্রথমে হলুদ একটি কাপড় আর উপরে ত্রিপল দিয়ে শুরু করলেও ধীরে ধীরে বেড়ার স্থাপনা, তারও পরে ইটপাথরের স্থাপনা শুরু করেন শরণাংক থের। ৭-৮ বছরের ব্যবধানে বনবিভাগের ১শ’ একরেরও বেশি জায়গা দখল করে নেন রনি ড্রাইভার ওরফে শরণাংক থের।

এই সময়টাতে ফলাহারিয়া যাওয়ার দুর্গম রাস্তা সুগম হয়, শিলক নদীর উপর ব্রিজ, কাঁচা রাস্তা পাকাকরণসহ নানা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ফলে শরণাংক থেরের কর্মকাণ্ডের ব্যাপক প্রচার প্রসারের পাশাপাশি অনুদান প্রাপ্তির পরিমাণও বাড়তে থাকে।

জানা যায়, তার এসব কর্মকাণ্ডে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করা টিটু বড়ুয়া, টুনটু বড়ুয়া, বিধু বড়ুয়ারা; যারা প্রত্যকেই স্থানীয় সংসদ সদস্য তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের পরিবারের বিভিন্ন সদস্যের ব্যক্তিগত স্টাফ।

এই দখলযজ্ঞের ধারাবাহিকতায় গায়ের জোরে পার্শ্ববর্তী সনাতনী সম্প্রদায়ের শ্মশান দখল এবং বিহার থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার আগে কালিন্দিরানী সড়কে মুসলিমদের জায়গার উপর বৌদ্ধমূর্তিসমেত একটি তোরণ স্থাপনকে কেন্দ্র করে মুসলিমদের সাথে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন শরণাংক থের।

এদিকে দিন দিন বনবিভাগে দখলদারিত্ব বৃদ্ধি পাওয়ায় বনবিভাগের সাথেও বিরোধ তীব্র হয় শরণাংক থেরের। বনবিভাগ শরণাংক থেরের বিরুদ্ধে পর পর ৮টি মামলা করে। প্রথম তিনটি মামলা হয় গত বছরের অক্টোবরের মধ্যে। যা উদ্ভুত পরিস্থিতির অনেক আগে।

অভিযোগ রয়েছে, শরণাংক থেরের অবৈধ দখলযজ্ঞে স্থানীয় সংসদ সদস্য ড. হাছান মাহমুদকে পাশে পাওয়ার আশা পূরণ না হওয়ায় তাকে প্রতিপক্ষ ও শত্রু ভাবতে থাকেন শরণাংক থের। ঠিক একইভাবে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারি ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়াকেও তার এই অবৈধ কর্মযজ্ঞে সহযোগী হিসেবে না পেয়ে শত্রু বিবেচনা করছেন তিনি।

শুধু তা নয়, এই অবৈধ কাজে সমর্থন না পেয়ে বাংলাদেশ বৌদ্ধকৃষ্টি প্রচার সংজ্ঞের সভাপতি ভদন্ত বৌদ্ধপ্রিয় মহথেরকেও প্রতিপক্ষ ভাবতে শুরু করেন শরণাংক। তারই অংশ হিসেবে শরণাংক থের ও তার সহযোগীরা বিশিষ্ট এই ব্যক্তি ছাড়াও বিভিন্ন লোকের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিষোদ্গার করছেন, কুৎসা রটাচ্ছেন। এসব কারণে রাঙ্গুনিয়া থানায় শরণাংক ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে আইসিটি অ্যাক্টসহ বিভিন্ন আইনে অন্তত ৮টি মামলা হয়েছে। প্রতিদিন শরণাংক থেরের গ্রেপ্তারের দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মানববন্ধন হচ্ছে রাঙ্গুনিয়ার গ্রামে। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকজনও এসব বিক্ষোভে অংশ নিয়ে ভণ্ড, প্রতারক, ভূমিদস্যু শরণাংকের গ্রেপ্তার দাবি করছেন।

সাধারণত বৌদ্ধভিক্ষুরা থাকেন জগতের সকল বিলাসব্যসনের উর্ধ্বে। পক্ষান্তরে বৌদ্ধ ধর্মীয় গুরু সেজে শরণাংক থের বিলাসী জীবনযাপন করেন। ব্যবহার করেন সিক্স প্লাসের মতো দামি মোবাইল। মিনারেল ওয়াটার শুধু খান তা নয়, ব্যবহারও করেন। বৌদ্ধবিহার এলাকায় সুড়ঙ্গ করে মাটির নিচে দুইতলা বাড়ি বানিয়েছেন। আধুনিক সাজসজ্জার সবকিছুই সংযোজিত বাড়িটিতেই থাকেন তিনি বিশেষ বিশেষ সময়ে। ওই ভিক্ষুর সেবায় নিয়োজিত কয়েকজন ছাড়া আর কেউ সেই গোপন বাড়িতে প্রবেশ করতে পারে না।

তার এক বৌদ্ধবিহারের জন্য ৫০ একরের বেশি জায়গা দখলাবাজি। অনধিক ৫০ জন মানুষের একটি বিহারে ২৪টা বৈদ্যুতিক সংযোগ। জ্ঞানশরণ বৌদ্ধ বিহার নাম দিয়ে সংরক্ষিত বনাঞ্চল দখল করে কংক্রিটের অসংখ্য স্থাপনা করে তিনি সেখানে নিজের রাম রাজত্বই কায়েম করতে চান বলে স্থানীয়রা জানান।

শরণাংক থেরের গ্রেপ্তার চায় সনাতন ধর্মাবলম্বী ঐক্য পরিষদ

​​​​​​এদিকে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার ফলাহারিয়া গ্রামে সনাতন সম্প্রদায়ের প্রাচীন শ্মশান দখলকারী বৌদ্ধ ধর্মীয় ভিক্ষু শরণাংক থেরকে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছেন সনাতন ধর্মাবলম্বী ঐক্য পরিষদের নেতারা। গত রোববার (১১ অক্টোবর) সকাল ১১ টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে আয়োজিত মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে এই দাবি ওঠে।

নেতৃবৃন্দ বলেন- ভণ্ড, প্রতারক, মিথ্যাবাদী, ভূমিদস্যু শরণাংক থের রাঙ্গুনিয়ার ফলাহারিয়া গ্রামে সনাতন সম্প্রদায়ের প্রাচীন শ্মশান দখল করে সেখানে কাউকে সৎকার করতে দিচ্ছে না। বৌদ্ধ ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে বনবিভাগের একশ’ একর জায়গা দখল করে নিয়েছে। স্থাপনা নির্মাণের নামে হাজার হাজার গাছ উপরে ফেলে বনবিভাগ ধ্বংস করেছে। এসব অপকর্ম প্রকাশের পর এলাকা থেকে বিতাড়িত হয়ে এখন রাঙ্গুনিয়ার শত বছরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের নতুন খেলায় মেতে ওঠেছে শরণাংক।

অন্য ধর্ম ও বিশিষ্টজনদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিনিয়ত উসকানিমূলক ভিডিওবার্তা ও বক্তব্য দিচ্ছে। এতে করে পুরো রাঙ্গুনিয়া এখন থমথমে। এখন দুর্গাপূজা। যে কোনো মুহূর্তে অশান্ত হয়ে উঠতে পারে শান্তির জনপদ রাঙ্গুনিয়া। ঘটে যেতে পারে রক্তক্ষয়ী সংঘাত, সংঘর্ষ। তাই বড় ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে শরণাংক থেরকে গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা।

৫০ একর বনভূমি দখল নিতে অপপ্রচারে বৌদ্ধ ভিক্ষু

চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের খুরুশিয়া রেঞ্জের সংরক্ষিত বনে ৫০ একর জায়গা দখল করার ঘটনা ভিন্ন খাতে নিতে বৌদ্ধ ভিক্ষু শরণাংক থের ও তার অনুসারীরা দেশ-বিদেশে অপপ্রচার ও মিথ্যাচার করছে বলে জানিয়েছে বন বিভাগ।

চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক শাহ চৌধুরী স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য উল্লেখ করা হয়েছিল। এতে উল্লেখ করা হয়, চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের প্রশাসনিক অধিক্ষেত্রাধীন খুরুশিয়া রেঞ্জের খুরুশিয়া বিট এবং সুখবিলাস বিটের ফলাহারিয়া মৌজায় ১৯৩১ সনে ঘোষিত সংরক্ষিত বনভূমি যার আর, এস দাগ নং-৬৫৮,৬৫৯,৬০৭ এবং বি,এস দাগ নং-৬০৫,৬৪৬,৬৪৭। জনৈক ভদন্ত শরণাংক থের, পিতা-দিলীপ বড়ুয়া, উপজেলা হাটহাজারী, জেলা-চট্টগ্রাম ধর্মীয় ধ্যানের নামে জ্ঞানশরণ মহাঅরণ্য বৌদ্ধ বিহার নাম দিয়ে সরকারি আনুমানিক ৫০ একর সংরক্ষিত বনভূমি জবরদখল করে ছোট-বড় মূর্তি, তোরণ, পুকুর, টিনের ঘরসহ বিবিধ স্থাপনা আইন বহির্ভূতভাবে নির্মাণ করেন।

এছাড়া আরও ৫০ একর সংরক্ষিত বনভূমি দখল করার উদ্যোগ শরণাংক থের নিয়েছেন জানিয়ে বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, “উক্ত জবরদখলকৃত সংরক্ষিত বনভূমি জবরদখলমুক্ত করার জন্য ভদন্ত শরণাংক থের-কে নোটিশ প্রদানসহ অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ কাজে বাধা প্রদান করলে সে ক্ষিপ্ত হয়ে বন কর্মচারী ও পুলিশকে অকথ্য ভাষায় গালি-গালাজসহ রোপণকৃত ৩ হাজার বিবিধ প্রজাতির চারা কর্তন, প্রস্তাবিত বাগানের ৩টি সাইনবোর্ড ধ্বংস, ২০১৯-২০ আর্থিক সনে বাগান সৃজনের নিমিত্তে উত্তোলিত ৭৬ হাজার ৬০০টি বিবিধ প্রজাতির চারা কর্তন ও ২০টি খুঁটি পুড়িয়ে ফেলে। এতে সরকারের ১১ লক্ষ তিন হাজার টাকার ক্ষতি হয়।”

এ প্রেক্ষিতে জবরদখলকারী ভদন্ত শরণাংক থেরের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগ কর্তৃক ৩টি পুলিশি মামলা এবং বন আইনের আওতায় ৩টি পি.ও.আর বন মামলা দায়ের করা হয়, যা বর্তমানে চলমান রয়েছে বলে বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।

বিজ্ঞপ্তিতে বন বিভাগ বলছে, “উক্ত জবরদখলকারী ও তার অনুসারীরা হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার মানসে বিভিন্ন সময়ে বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য বিভিন্ন মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে দেশ-বিদেশে অপপ্রচার ও মিথ্যাচার করে যাচ্ছেন। প্রকৃতপক্ষে ভদন্ত শরণাংক থের বন বিভাগ কর্তৃক বারংবার নিষেধ করার পরও বন বিভাগের জায়গা দখল করে নতুন স্থাপনা নির্মাণ অব্যাহত রাখলে বন বিভাগ বাধা প্রদান করে তখন ভিক্ষু ও তার অনুসারীরা বন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারি এবং পুলিশকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ ও হুমকি দেয়।”

এর আগে চলতি বছরের ৯ জুলাই রাতে শরণাংক থের নিজের ফেইসবুকে ১৪ মিনিটের একটি ভিডিওবার্তা পোস্ট দেন। সেই ভিডিওবার্তায় চলতে-ফিরতে স্থানীয় লোকজনের হাতে তার সহকর্মীরা বিভিন্ন ধরনের নির্য়াতনের শিকার হচ্ছেন মর্মে অভিযোগের পাশাপাশি তিনি সাম্প্রদায়িক অভিযোগের তীর ছোঁড়েন খোদ রাষ্ট্রযন্ত্র ও সরকারের বিরুদ্ধে।

এরপরও শরণাংক থের কর্তৃক দখলকৃত বন বিভাগের সরকারি জায়গায় আবার সাইনবোর্ড লাগিয়ে দেয় কর্তৃপক্ষ। যদিও আগে বন বিভাগ অনেকবার সাইনবোর্ড লাগালেও শরণাংকের নেতৃত্বে তার অনুসারীরা এসব সাইনবোর্ড ভেঙে ফেলে দিত বলে অভিযোগ রয়েছে।

 

ট্যাগ :

আরো সংবাদ

ফেইসবুকে আমরা



আর্কাইভ
December 2024
M T W T F S S
 12
3456789
10111213141516
17181920212223
24252627282930
আলোচিত খবর

error: কি ব্যাপার মামা !!